স্বাদে অতুলনীয় সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কুমড়ো বড়ি
দেখতে যেমন সুন্দর, খেতে তার চেয়ে বেশি সুস্বাদু। শীতের খাবারে মুখরোচক স্বাদ আনতে মাছ-সবজিতে কুমড়ো বড়ির প্রচলন দীর্ঘ দিনের। শীতকে কেন্দ্র করে অতিযত্নসহকারে শৈল্পিকভাবে এই খাদ্য তৈরি করছে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীরা। এই কুমড়া বড়ি তৈরি করে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করেও অনেকে সংসারে আনেন স্বচ্ছলতা। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু কুমড়া বড়ি তৈরির কাজে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে কারিগররা।
জানা যায়, শীত মৌসুমে বাজারে নানা ধরনের সবজির সমাহার দেখা যায়। গ্রামঞ্চলের নদী ও খাল-বিলে এই সময়ে পানি কম থাকে। এই সময়ে মাছের সাথে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের সবজিও বাজারে ওঠে। এই সবজি আর মাছ রান্নাতে ভোজন রসিক খাবারে ব্যবহার হয় ঐতিহ্যবাহি কুমড়া বড়ি। কিন্তু কাজের ব্যস্তার কারণে অনেকেই ইচ্ছা থাকলেও সুস্বাদু এই কুমড়া বড়ি তৈরি করতে পারে না। সেই চাহিদার অনেকাংশ পুরণ করছে সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের নারীরা।
কারিগররা জানান, দেশীয় উপাদানে তৈরি করা হয় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ কুমড়া বড়ি। প্রথমে গাছপাকা সাদা বর্ণের চালকুমড়া কুচি কুচি করে কাটতে হয়। তারপরে কলাইয়ের ডাল ভিজিয়ে পাটায় বেটে, চালকুমড়া আর কলায়ের ডাল একসঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ভালো করে মাখিয়ে বাঁশের চাটাইয়ের ওপরে ছোট ছোট করে বড়ি তৈরি করে বিছিয়ে দেওয়া হয়। দুই-তিন দিন ভালো করে রোদে শুকালেই খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায় সুস্বাদু কুমড়ো বড়ি।
বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মসুর ডাল (চিকন) এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়, যা ৫ মাস আগে ছিল ১১০ টাকা। মসুর ডাল (মোটা) এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। যা আগে ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা। মাষকলাই ডাল এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়, যা আগে ছিল ১০০ থেকে ১০৫ টাকা। অ্যাংকার ডাল এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়, যা আগে ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। মুগের ডাল এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়। একটি কুমড়ো ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা, যা আগে ছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা।
শাহজাদপুর উপজেলার তালগাছি গ্রামের কুমড়া বড়ি তৈরির কারিগর জাহানারা খাতুন বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে এই কুমড়ো বড়ি তৈরি করছি। মাসকলাইয়ের ডাল আর চাল কুমড়ার মিশ্রণে রোদে শুকিয়ে তৈরি করতে হয় এই বড়ি। কুমড়া বড়ি দিয়ে কৈ, শিং বা শোল মাছের ঝোল ভোজন রসিকদের বেশ জনপ্রিয় এবং সুসাদু। এই কুমড়ো বড়ি তৈরির উপযুক্ত সময় হলো শীতকাল। একারণে শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে কুমড়ো বড়ি তৈরির ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আমার মত এখন এলাকার শত শত নারী কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছে।
আরেকজন মনোয়ারা খাতুন জানান, শীত মৌসুমে কুমড়ো বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বাজারে বিক্রি করা হয়। শীতের সময় ব্যাপক চাহিদা থাকায় গ্রামাঞ্চলের নারীরা বাড়তি আয়ের জন্য কুমড়ো বড়ি তৈরি করেছেন। তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ গ্রামের বড়ি তৈরির কারিগর আব্দুল মতিন বলেন, এই বড়ি আমরা বংশ পরায়ণভাবে তৈরি করে থাকি। আমার বাপ-দাদা তৈরি করেছে, আমি তৈরি করেছি, এখন আমার ছেলে আর নাতিপুতি তৈরি করছে। বর্তমানে এই গ্রামের ২০ থেকে ২৫টি পরিবার কুমড়ো বড়ি তৈরি করে। সেই বড়িগুলো স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করছে।
শীতের সবজির সঙ্গে কুমড়ো বড়ির একটা যোগসূত্র খুঁজে পান অনেকেই। তাই চাহিদাও বেড়েছে এ সময়।আরেক কারিগর আল-আমিন বলেন, একটা সময় কুমড়ো বড়ি তৈরির জন্য শীল-পাটায় সারা রাত ধরে পরিবারের মেয়েরা ডাল বাটতেন। পরের দিন তা বড়ি বানিয়ে শুকাতে দেয়া হতো। বর্তমানে আধুনিকতার ছোয়ায় ছেলে মেয়েরা ভেলেন্ডার মেশিনের সাহায্যে ঘণ্টার মধ্যেই অনেক ডাউল গুঁড়া করে বড়ি তৈরি করে ফেলে। এই বড়ি তৈরি করার আগে পারিবারিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল ছিল না। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকত। কিন্তু বর্তমানে এ বড়ি তৈরি করে তারা অনেকটাই স্বচ্ছল। চাতাল বা খোলা থেকেও সরাসরি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে এবং চাতালে আসা পাইকাররা কিনে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানেও বিক্রি করছে বলে তিনি জানান।
তাড়াশ উপজেলার বড়ি তৈরি চাতালের মালিক মুনছুর আলী বলেন, বড়ি তৈরি করতে প্রথমে প্রচুর পরিশ্রম করতে হতো। কিন্তু এখন মেশিনের মাধ্যমে ডাল গুঁড়ো করা হয়, শুধু হাতের মাধ্যমে বড়ি তৈরি করে রোদে শুকাতে হয়। প্রতিদিন আমার চাতালে ১২০ থেকে ১৩০ কেজি কুমড়ো বড়ি তৈরি হচ্ছে। প্রতি কেজি বড়ি চাতাল থেকে পাইকারি ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হয়। খুচরা বাজারে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রয় করা যায়। সরকারের দেয়া কিছু সুবিধা পেলে বড় পরিসরে বড়ি তৈরি করে রপ্তানি করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।
উপজেলার নওগাঁ গ্রামের কুমড়া বড়ি ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে মাষকলাই ডালের কুমড়ো বড়ি প্রতি কেজি ২০০ টাকা, মসুর ডালের কুমড়ো বড়ি ১৪০ টাকা কেজি। আর অ্যাংকার ডালের কুমড়ো বড়ি প্রতি কেজি ১০০ টাকায় পাইকারি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে খুচরা বিক্রিতে কেজিতে আরও ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হলেও আগের মতো ক্রেতা নেই। সম্প্রতি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের কেনাকাটা কমেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বাবুল কুমার সুত্রধর জানান, মাঁচা ও টিনের চালে কৃষকরা চাল কুমড়ার চাষ করে থাকেন। উৎপাদিত চাল কুমড়া থেকে এসব বড়ি তৈরি করা হয়। বড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ চাল কুমড়ার চাহিদা বাড়ে। তাই অনেক কৃষক চাল কুমড়াও বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করছে। গ্রামের নারীরা কুমড়ো বড়ি তৈরি করে বাড়তি আয় করছেন।
তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পৃষ্টপোষকতা পেলে তারা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। যুব উন্নয়ন অফিসার আ ফ ম নজরুল ইসলাম বলেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহি কুমড়ো বড়ি তৈরি করে অনেক যুবকদের বেকার সমস্যা দূর হচ্ছে। আমাদের অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ করিয়ে ঋণের ব্যবস্থা করে তাদের ব্যবসা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করা হবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. রাশেদুল রহমান বলেন, এই কুমড়া বড়ি গ্রাম বাংলার একটি ঐতিহ্যের অংশ। এই কাজের সাথে বেশির ভাগ নারী শ্রমিক কাজ করে থাকেন। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য বড়ি তৈরির কারিগরদের একটি তালিকা করে তাদের উন্নত প্রশিক্ষণসহ সল্প সুদে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করা হবে। বাংলার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আমরা সবসময় পাশে আছি। বিশেষ করে নারী ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তা যদি আমাদের কাছে আবেদন করে তবে অবশ্যই তাকে সহযোগিতা করা হবে বলে তিনি জানান।
এএজেড