‘টুরিওয়ালি’ তছলিমা এখন সফল উদ্যোক্তা
হস্তশিল্প আঁকড়ে ধরেই জীবন সংগ্রামে এগিয়ে গেছেন পাবনার চাটমোহরের তছলিমা খাতুন। তালপাতা দিয়ে তৈরি নানা রকমের ঝুড়ি তৈরি করে তা বিক্রি করেই চলত ছতলিমার সংসার। তাই আশপাশের লোকজন অবহেলা করেই বলত ‘টুরিওয়ালি’। কিন্তু একদিনের অবহেলিত টুরিওয়ালি এখন হয়ে উঠেছেন সফল উদ্যোক্তা।
১৭ বছরের সংগ্রাম শেষে সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যোক্তার খাতায় নাম উঠেছে তছলিমার নাম। তিনি শুধু নিজের জীবনমান বদলে ফেলেননি, বর্তমানে নিজ এলাকার দেড় শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানে ভূমিকা রেখেছেন। নিজ এলাকার গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়নেও আলোকবর্তিকা হয়েই কাজ করছেন জীবন সংগ্রামে অদম্য এই নারী।
রাজশাহী বিভাগীয় উদ্যোক্তা সম্মেলন ও পণ্য প্রদর্শনী মেলায় ‘তছলিমা হ্যান্ডিক্রাফটস বিডি’ স্টলের স্বত্বাধিকারী তছলিমা খাতুন অংশ নিয়েছেন। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে। এসময় নিজের সংগ্রামী জীবনের কথা জানান।
তাছলিমা খাতুনের বাড়ি পাবনার চাটমোহর উপজেলায়। অতি দরিদ্র একটি পরিবারে ১৯৭৫ সালে জন্ম তছলিমার। মায়ের সহযোগী হিসেবে ৭ বছর বয়স থেকেই হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তছলিমা। তছলিমার মা অন্যের বাড়িতে ধান ভাঙানোর কাজ করতেন। এক মণ ধান ভাঙলে এক কেজি চাল পেতেন। তা দিয়েই খেয়ে না খেয়ে চলতো তাদের সংসার। এদিকে ধান ভানলে তার মায়ের পায়ের গোড়ালি ফেটে রক্ত বের হতো। পরে নানির পরামর্শে পরিত্যক্ত তালপাতা দিয়ে হস্তশিল্প বানিয়ে দিতেন মা। আর তা বিক্রির কাজ শুরু করেন তছলিমা। পঞ্চম শ্রেণির পাস করার পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় তছলিমার।
তিনি বলেন, ‘আমার জীবন অনেক কষ্টের। ৩ টাকার বইয়ের জন্য পড়াশোনা করতে পারিনি। পড়াশোনা তেমন জানি না বলে খুব বেশি উন্নতিও করতে পারিনি। তবে এখন অনেক ভালো আছি। ভাইদের পড়ালেখা করিয়েছি। বাবার চিকিৎসা করাচ্ছি। মা ২০১৫ সালে মারা গেছেন।’
১৯ বছর বয়সে বিয়ে হয় তছলিমার। যৌতুক দিতে না পারায় তার উপর চলত শারীরিক মানসিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে অসহ্য হয়ে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়ি। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে পাবনায় কলেজে পড়েন। ছোট ছেলে এবার এসএসসি তে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।
এই উদ্যোক্তা বলেন, আমি চাই, আমার ছেলেরা শিক্ষিত হোক। মানুষের দ্বারে দ্বারে চাকরির জন্য না ঘুরে এই হস্তশিল্পকে পুঁজি করে উদ্যোক্তা হোক। বিদেশে এগুলো বিক্রি করে বড় হোক। কারণ এটা আমার কাছে লক্ষ্মী। আমি চাই আমার ছেলেরাই যেন মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারে। ছেলেরাও এবিষয়ে আগ্রহী।
তিনি বলেন, ‘সাত বছর বয়সে মায়ের বানানো তালপাতার ঝুড়ি বিক্রি করেছি ট্রেনে। এরপর নিজের বানানো ঝুড়ি বিক্রি করতে বাবার সঙ্গে গেছি চাপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, খুলনায়। সারাদিন শহরে বিক্রি করে হোটেলে খেয়ে প্ল্যাটফর্মে ঘুমাতাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি কড়ইগাছের নিচে আমাকে রেখে বাবা সারাদিন এসব জিনিস বিক্রি করতেন। সারাদিন পরে সন্ধ্যা বেলায় এসে বাবা ১ টাকা দিয়ে ভাত কিনে খাওয়াতেন। এভাবেই কষ্টে দিন গেছে।’
১৯৯১ সালে ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফট ও এটিএম নামে কোম্পানি তছলিমার হস্তশিল্প পছন্দ করে তারা বড় অর্ডার দেয়। কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে সে সময় কিছু সমস্যা হয়ে যায়। পরে ১৯৯৬ সালে তার মা ঢাকায় গিয়ে ওই অফিসে যোগাযোগ করে আবারও কাজ শুরু করেন। এখনো তাদের সঙ্গে কাজ করছেন।
তছলিমা বলেন, আমাদের তৈরি পণ্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যায়। আমাকে তারা কম্পিউটারে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী নকশা দেখায়, সেটি আমি বানিয়ে দিই। আমাকে যে ডিজাইনই দেওয়া হোক আমি বানাতে পারব।
তছলিমা খাতুন আরও বলেন, মে ও জুন মাসে পাকশির চর থেকে সংগৃহীত কাশিয়া, তালপাতা, জুট, চুল বাঁধার ফিতা ও প্লাস্টিকের সংমিশ্রণে নানা ডিজাইনে পণ্য তৈরি করেন তিনি। শিক্ষিত না হওয়ায় সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি।
এসএন