খেজুর রসের মিষ্টি স্বাদে একদিন
ষড় ঋতুর বাংলাদেশে বিভিন্ন ঋতু প্রকৃতিতে নানা রূপ নিয়ে হাজির হয়। বর্ষার বৃষ্টি ও বসন্তের ফুলের সমারোহ কে না ভালোবাসে? অন্যদিকে হেমন্তের নবান্ন উৎসব আর শীতের খেজুর রস প্রত্যেকের মনকে করে আন্দোলিত। এখন প্রায় হেমন্তের শেষ।
শীতের বাকি মাত্র কয়েকদিন। তবে উত্তরাঞ্চলে এরই মধ্যে শীত পড়ে গেছে। দেখা মিলছে কুয়াশার। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সকালের মিষ্টি রোদ এই প্রকৃতিকে যেন আরও সৌন্দর্যে রাঙিয়ে তুলছে। সবুজ ঘাসের ডগায়, গাছের পাতায় জমতে শুরু করেছে শিশির কণা। অন্যদিকে চাষিরা সূর্যের ঘুম না ভাঙতেই চলে যাচ্ছেন খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে। গ্রামীণ মেঠোপথের দুই পাশে বা ফসলের মাঠের আইলে বেড়ে ওঠা খেজুর গাছ থেকে চাষি খেজুর রসের হাঁড়ি সংগ্রহ করে আনেন। এরপর সেই হাড়ি থেকে রস বড় একটি ড্রামে ছাকনি দিয়ে রসটাকে পরিষ্কার করে নেন। কেউ কেউ এই রস কলসিতে ভরে শহরে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করেন। আবার কেউ কেউ রস থেকে গুড় তৈরি করেন। দেশে খেজুরের পাটালি গুড়ের চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক।
তেমনি এক হেমন্তের ভোরে কয়েক বন্ধু মিয়েলে আমরা বেরিয়েছি খেজুর রস খেতে। কয়েক দিন আগেই আমার বন্ধুকে এই পরিকল্পনার কথা জানাই। এরপর রাজশাহী কাছেই বানেশ্বরের তাতারপুরে চলে যাই আমরা।
শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) ভোর সাড়ে ৫টা। বন্ধু সামিউলের ফোন। কোনো মতে কল রিসিভ করতেই বলে উঠল 'তাড়াতাড়ি উঠ। খেজুর রস খেতে যেতে হবে। রেডি হয়ে রাস্তায় আয়।'
তাপমাত্রা ১৯ ডিগ্রি। লেপের মধ্যে থেকে বের হতেও ইচ্ছে করে না। এদিকে আমি কখনো খেজুর রস খাইনি। তাই সেটা নিয়ে বেশি কৌতুহলও আছে। কেমন খেতে খেজুর রস আর রস থেকে কীভাবে গুড় বানায়? লেপের আরাম আর অলসতা ঝেড়ে ফেলে চটপট তৈরি হয়ে নিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল গেট পেরিয়ে শুরু রাস্তায় পায়ে হাঁটা। ভোরের ঘোলাটে ভাব তখনো কাটেনি। রাস্তার ধারে বৈদ্যুতিক বাতিগুলো জ্বলছে।
কিছু দূর যেতেই আমার সঙ্গে যুক্ত হলো সামিউল, পারভেজ ও রায়হান। তারা তিনজনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী। বিনোদপুর পৌঁছে কিছুক্ষণ বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাস না পেয়ে লেগুনায় উঠলাম। বানেশ্বর পৌঁছে একটা ভ্যান নিয়ে হৃদয় ভাইয়ের (খেজুর রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করেন) বাড়ি তাতারপুর রওনা। বাড়ি পৌঁছে হৃদয় ভাইকে পেলাম না। এর আগেই তিনি খেজুর রস সংগ্রহে চলে গেছেন। হৃদয়ে ভাইয়ের মা আমাদের বসতে বললেন। আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। এরপর হৃদয় ভাই দুইটি বড় ড্রামে করে খেজুর রস সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন। পরে বাড়ির পাশে কিছু খেজুর গাছ থেকে আমরাও গেলাম রস সংগ্রহে। এই প্রথম আমরা গাছ থেকে খেজুর রস সংগ্রহ করি। অনেক ভালো লাগা এই মহূর্ত।
হৃদয় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তিনি তিন বছর ধরে খেজুর রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির কাজে যুক্ত হয়েছেন। এর আগে তার বাবা এই কাজ করতেন। তিনি এই গুড় অনলাইনে বিক্রি করেন।
তার মা( হৃদয়ের মা) জানান, হৃদয়ের বাবা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে এখন অসুস্থ। তাই গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ ছেলেই করেন। তাদের প্রায় ২০-২৫টি খেজুর গাছ আছে। যেগুলো হৃদয়ের বাবা নিজেই লাগিয়েছেন।
প্রথমবারের মতো খেজুরের রস খেলাম। সেসময় আমাদের অনুভূতি ছিল অন্যরকম। আমার আর ধৈর্য সইছে না। আমি খেজুর রস প্রথম খাচ্ছি। আমি অভিভূত। রস খেতে খেতে পারভেজ শুধু একটি কথাই বলল 'অসাধারণ'। আর কোনো কথা বলতে পারল না। অন্য দিকে সামিউল ও রায়হানের ও একি অবস্থা। শীতের সকালে ঠান্ডা আবহাওয়ায় খেজুর রস খেতে কী যে ভালো লাগে রস খেয়ে তা বুঝলাম।
দেখলাম রস থেকে কীভাবে গুড় বানায়। চুলোর কাছে বসে হৃদয় ভাইয়ের বাবা তাপ দিচ্ছেন আর তার মা রসটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। বলতে গেলে রস থেকে গুড় তৈরির কারিগর হৃদয়ের মা ও বাবাই। মনে মনে ভাবছিলাম এমন সুন্দর সকাল যেখানে পাওয়া যায় সেখানে থেকে গেলেই আরও ভালো লাগত। প্রকৃতির সৌন্দর্য, শীতের সকালের মিষ্টি রস জীবনকে যেন পরিতৃপ্ত করে তোলে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় চলে আসতে হবে।
আসার সময় রসের দাম দিতে গেলে হৃদয় ভাই নারাজ হন। বলেন এরজন্য কোনো টাকা দিতে হবে না। আমরা আবাক হলাম! অনেক বলার পরেও যখন আমরা মূল্য দিতে ব্যর্থ হলাম। কী করা যায়, ভেবে তখন রস থেকে তৈরি করা পাটালি গুড় কিনলাম। সেই গুড়ের স্বাদও অসাধারণ। এখনো মুখে লেগে আছে সেই স্বাদ। রস ও গুড়ের স্বাদ এবং হৃদয় ভাইয়ের আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করে। এরপর বিদাই জানিয়ে চলে আসি আমাদের দ্বিতীয় বাড়ি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এসএন