গানেই প্রাণ বাঁধা কাঠমিস্ত্রি উজেন্দ্রনাথের
নেশা আর পেশা যখন আলাদা হয়, তখন জীবনে নেমে আসে দুঃসহ যন্ত্রণা। বিশেষ করে শিল্পপ্রেমী মানুষ এমন দোটানায় ভুগেন। মন অবিরাম সাঁতার কাটে শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে, এদিকে পেটের ভেতরের ছুঁচোটা গুতো মারে বিরামহীন। সরস্বতীর সেবা করলে লক্ষ্মীর হাত সংকুচিত হয়। এমনই টানাপোড়েনে জীবন কাটছে ঠাকুরগাঁ সদরের আকচা ইউনিয়নের বাগপুর এলাকার শিল্পী উজেন্দ্রনাথ বর্মণের।
উজেন্দ্রনাথের মনের খোরাক যোগায় সংগীত। তাতে উদরপূর্তি হয় না বলেই কাঠমিস্ত্রির কাজ করতে হয়। অভাবের সংসারে পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কলম ধরেছেন। ছোটবেলা থেকেই গানের সঙ্গে প্রাণ বেঁধেছেন উজেন্দ্রনাথ। স্বপ্ন ছিল বড় শিল্পী হওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি তার। তবে অভাব-অনটন আর দুঃখ-দুদর্শার মধ্যেও গান ছাড়েননি। মাঠে-ঘাটে কাজ করতে করতে মনের জানালা খুলে গান গেয়ে উঠেন আপন মনে। কখনোবা পরিচিতজনদের অনুরোধে গান গেয়ে শোনান তিনি।
সংগীত নিয়ে প্রবল আগ্রহ থাকলেও দারিদ্র্যের ঘা খেয়ে বার বার বিতাড়িত হয়েছেন বিদ্যা দেবীর কোল থেকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়া হয়নি তার। রেডিওতে গান শুনে মুখস্ত করতেন তিনি। ২০০৫ সালে স্থানীয় একটি সংগীত বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ২০০৮ সালে বাংলাদেশ বেতার ঠাকুরগাঁওয়ে অডিশন দিলে শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। এরপর নিজ লেখা গানে ও নাটকে বেশ কিছু যাত্রা দলের সঙ্গে অভিনয় ও গান করেছেন। পুরস্কারও পেয়েছেন অনেক। স্থানীয়রা তার গানের প্রশংসাও করতেন। এতে করে গানের প্রতি তার আরও বেশি আগ্রহ জন্মায়।
মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে চলছে তার জীবনযুদ্ধ। প্রতিদিন গঞ্জ থেকে ১৫ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে শহরে আসেন কাজ করতে আসেন। সন্ধ্যায় কাজ শেষ বাড়ি ফিরে আবার মাঠে কাজ করেন। প্রতি শুক্রবার এলাকার শিশুদের বিনাপয়সায় গান শেখান। সহায়-সম্পত্তি বলতে তেমন কিছু নেই এই। শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও গান তার মুখে লেগেই আছে। গানই তার জীবন।
স্থানীয়রা ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, উজেন্দ্রনাথের গানের গলায় তারা মুগ্ধ। মানুষ তার দেখা পেলেই আবদার করে বসেন গান শোনানোর জন্য। উজেন্দ্রনাথও কাউকে কখনো নিরাশ করেন না। গান গেয়ে খুশি করেন মানুষকে। তবে গান গেয়ে নিজের আত্মার তৃপ্তি মেটালেও এই মানুষের জীবন ঘেরা দুঃখ-গাঁথায়।
উজেন্দ্রনাথ বর্মণ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, লেখাপড়া বেশি দূর করতে পারিনি। তবে স্কুলে পড়া মুখস্ত করার চেয়ে গান মুখস্ত করার প্রতিই আমার বেশি আগ্রহ ছিল। তখন সবাই আমার গানের গলার প্রশংসা করত। তাদের প্রশংসা আমাকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করত। ইচ্ছে ছিল বড় শিল্পী হব। অর্থের অভাবে আমার ইচ্ছের মৃত্যু হয়। তবে সংসার জীবনের শত অভাব-অনটনের মধ্যেও আত্মার খোরাক গানকে কখনো ছাড়িনি। কবি মমেন সিংহ ২০১৪ সালে পুরাতন ঠাকুরগাঁওয়ে বলদা পুকুর সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে আমি বিনাপারিশ্রমিকে বাচ্চাদের কবিতা ও গান শেখাই। আমার লেখা গান, কবিতা পুরস্কারও পেয়েছে। এলাকার অনেক বাচ্চা আমার বাড়িতে আসে গান শেখার জন্য। তাদের বিনাপারিশ্রমিকে গান শেখায় কারণ আমার লক্ষ্য একটাই সুস্থ সংগীত চর্চায় মানুষ থাকুক।
কবি মোমেন সিংহ ঢাকাপ্রকাশকে জানান, উজেন্দ্রনাথ বর্মন পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। অভাব-অনটনের মধ্যেও গান চর্চা করে যাচ্ছেন। নিজ অর্থায়নে বলদা পুকুর সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তিনি গ্রামে ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের স্কুলে এসে সংগীত শেখান। এতে তিনি কোনো টাকা নেন না। তিনি গান লিখেন, কবিতা লিখেন আবার বই হিসেবে প্রকাশ করেন। তিনি যেন সংগীত নিয়ে অনেক দূর যেতে পারেন।
এসএন