সমাজ হবে অন্যায়ের ঘর
ইমরুল কবির সুমন
আধুনিক সভ্যতার যুগে আমরা বসবাস করছি, ইন্টারনেট তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে মানুষ আরো বেশি আধুনিক হচ্ছে। নিজস্ব সংস্কৃতির কথা মানুষ ভুলে পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখন গ্রামের প্রতিটি ছেলের কাছে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট থাকে। মুহূর্তের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত, ভিডিও ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে কিন্তু সার্বিকভাবে এটা তাদের মনে অপসংস্কৃতির বীজ বপন করছে।
আগে গ্রামে দেখতাম, জেলেরা মাছ ধরার সময় বিভিন্ন রকম গান করতেন। গ্রামের উঠানে রাতে লোকগানের আসর বসতো কিন্ত সেই স্মৃতিগুলো এখন কোথায় চলে গেল? আমরা দেখতাম, গ্রামে অগে ভোরে প্রতিটি ছেলে, মেয়ে মক্তবে যেত ধর্মীয় শিক্ষার জন্য। বর্তমানে তারা বিদ্যালয়ে যায়। তারপরও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি। মানুষের ভেতর নৈতিক অবক্ষয় এত তলানিতে চলে গেছে, ভাবলে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আমার এক সহপাঠীর সঙ্গে আলাপ হলো অনেকদিন পর। উত্তরবঙ্গের কোন এক জেলায় বাড়ি তার। এক পর্যায়ে আমাকে বলল, বন্ধু দেশের অবস্থা এমন হচ্ছে যে, এখন গ্রামের বাড়ি যেতে ভয় লাগে। বললাম, কেন কি হয়েছে? তখন সে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কটি ধর্ষণের কথা বলল, ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নরসিংদীর ঘোড়াশাল স্টেশন এলাকায় স্বামী-স্ত্রী ঘুরতে গেলে তিন বখাটে তাদের উত্ত্যক্ত করেছে। একপর্যায়ে বখাটেরা স্বামীকে মারধর করে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করেছে। ২ আগস্ট কুষ্টিয়া থেকে নারায়গঞ্জগামী যাত্রীবাহী বাস টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় ডাকাতির কবলে পড়েছে। বাসে একজন নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ঘটনার ঠিক চারদিন পর ৬ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুরে তাকওয়া পরিবহনের মিনিবাসে গণধর্ষণের স্বীকার হয়েছেন আরেক গৃহবধূ। গণমাধ্যমে মাধ্যমে জানা গিয়েছে, কক্সবাজার সদর উপজেলার রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ২৫ বছরের একজন স্কুল শিক্ষিকাকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে। একইদিন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় সাত বছর বয়সী সন্তানের গলায় ছুরি ধরে তার মাকে ধর্ষণ করেছে ইজিবাইক চালক ও চারযাত্রী (প্রথম আলো ২৪ আগস্ট, ২০২২)।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)’র একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে ১৮ বছরের কমবয়সী ৪শ ২৪ জন নালী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক ৩শ ৪ জন সহ মোট ৭শ ২৮ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত। এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তাহলে সমাজের অবস্থা কোনদিকে ধাবিত হবে? আমাদের ভাবতে হবে। সমাজ আমাদের, রাষ্টও। সমাজ-রাষ্ট্র নিয়ে শুধু সরকার ভাববে? না কথাটি সঠিক না, ভাবতে হবে সচেতন জনসমাজকেও সবসময়।
আমাদের নিজেদের মনকে প্রশ্ন করতে হবে, কেন আমরা সবার জন্য সহাবস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি না? মনকে আরো প্রশ্ন করতে হবে, নৈতিক মূল্যবোধ ও সুশাসন কেন আমাদের মাঝে জাগ্রত হচ্ছে না? সমাজের কোন স্থানে মেয়েরা নিরাপদ নয় কেন? অফিস থেকে বাসা, বাজার থেকে রাস্তা, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় যাদ মেয়েরা কটুদৃষ্টির শিকার হন, তাহলে প্রশ্ন করেন নিজেকে-কোথায় নিরাপত্তা পাবে আমাদের মা-বোনেরা? তাই এখন উচিত হবে, কঠিন আইনের পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অনুশাসন প্রয়োগের। না হলে ধর্ষণের প্রবণতা ও সংখ্যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাবে। সমাজ হবে অন্যায়ের আঁতুরঘর।
লেখক : প্রভাষক, সমাজকর্ম, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ওএফএস।