তরুণ মজুমদারের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করছেন দেবশ্রী রায়
দেবশ্রী রায়ের বয়স এখন ৫৯। ভারতীয় বাংলা সিনেমার বরেণ্য এই নায়িকা, অভিনেত্রীর অনেক গুণ। তিনি কাজ করেন হিন্দি চলচ্চিত্রেও। নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার, হাল আমলে রাজনীতিবিদ ও পশু সংরক্ষণ অধিকারের কমী। দেবশ্রীকে বাংলা বাণিজ্যিক ছবির জগতে ‘রাজত্ব করা রাণী’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১শর বেশি ছবিতে অভিনয় করে তিনি ৪০’র বেশি পুরস্কার জয় করেছেন। একটি জাতীয় পুরস্কার, তিনটি বিজেএফএ, পাঁচটি কলাকর ও একটি আনন্দলোক আছে।
তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবেও অত্যন্ত খ্যাতিমান। ভারতের লোক নাচগুলোকে ছবির নায়িকা দেবশ্রী মঞ্চে তুলে ধরে খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি উদ্ভাবনী নৃত্যশিল্পী হিসেবেও বিখ্যাত। ভারতীয় ক্লাসিক্যালে, আদিবাসীদের নাচেও দক্ষ। নিজের নামে তিনি ‘দেবশ্রী রায় ফাউন্ডেশন’ গড়ে তুলেছেন। একটি অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। রায়দিঘী থেকে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় নির্বাচিত ২০১১ থেকে ২১ টানা ১০ বছর।
বাবার মৃত্যুর পর ভারতে ও হিন্দু ধর্মের মানুষরা যে আচারগুলো পালন করেন, কিংবদন্তী চলচ্চিত্র পরিচালক ও পঞ্চপান্ডবের অন্যতম তরুণ মজুমদারের মৃত্যুর পর পালন করেছেন দেবশ্রী। তার বাবাসম মানুষটির জন্য নিষ্ঠাবান দেবশ্রী পারলৌকিক কর্মগুলো সম্পাদন করেছেন। ৮ জুলাই তিনি পূর্জাআচনা পর্বে প্রথম মন্দিরে গিয়েছেন, বাবার মতো মেয়েকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা করা তরুণ মজুমদারের জন্য।
ভারতের বরেণ্য ও পদ্মশ্রী পুরস্কার জয় করা তরুণ ও সাধনা রায় দম্পতির কোনো সন্তান ছিল না। মেয়ে হিসেবে বড় করেছেন, বিকশিত করেছেন তারা দেবশ্রীকে। তারা মৌসুমী চ্যাটার্জিকেও তাদের মেয়ের মতো ভালোবেসে বড় করেছেন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ ও ব্যক্তিগত জীবনে। ভালো নাম তার ইন্দিরা চট্টোপাধ্যায়। সিনেমায় নাম মৌসুমী চ্যাটার্জি, মৌসুমী নামটিও তরুণ মজুমদারের দেওয়া। ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা ছবিতে নিজের কাজের জন্য অত্যন্ত স্বীকৃত ও শ্রদ্ধার পাত্রী। ১৯৭০’র দশকে ভারতীয় প্রধান সিনেমা ভুবন হিন্দি ছবির জগতে তিনি সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নেওয়া অভিনেত্রীদের একজন ছিলেন। ২০১৯ সালে মৌসুমী বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। মেয়েটি কলকাতার, ব্রাক্ষণ পরিবারের। আসল দেশ বাংলাদেশের বিক্রমপুরে। দেশভাগের পর ওপারে শরণার্থী। দাদা ছিলেন বিচারপতি আর বাবা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার। বিয়ের পর মৌসুমী তার সিনেমার ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। ‘বালিকা বধু’তে ১৯৬৭ সালে তাকে নিয়ে এসে তরুণ মজুমদার ক্যারিয়ারের শুরু করে দেন।
এই ভালোবাসা ও মেয়ের মতো আদর পেয়েছেন তাদের কাছ থেকে মহুয়া রায়চৌধুরীও। মোটে ২৬ বছরে চলে যাওয়া মেয়েটির জন্ম ১৮৫৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, মারা গিয়েছেন ১৯৮৫ সালের ২২ জুলাই। বাংলা ছবির জগৎ তাকে অভিনয়ের জন্য মনে রেখেছে। জীবদ্দশায় তিনি বাংলা ছবির সবচেয়ে ব্যবসাসফল অভিনেত্রীদের একজন ছিলেন। তার কটি পুরস্কারের মধ্যে একটি ফিল্মফেয়ার আছে, সর্বত্র অভিনয় প্রশংসার জন্য। ‘আদমি আউর আওরাত’ ছবিটি মরক্কোর রাজধানী দামেস্কে ‘দামেস্কাস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ১৯৮৭’-এ প্রদর্শনের পর তাকে ‘মরোণত্তর সেরা অভিনেত্রী’র পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
এই তিন গুণী অভিনেত্রীকে তরুণ-সাধনা মেয়ের মতো ভালোবেসে গড়ে দিয়েছেন। ওপারে চলে গিয়েছেন পিতৃগুরুর আনেক আগে মহুয়া রায়চৌধুরী। তার ব্যথা আজীবন ভোগ করেন তারা। নিরবে চোখের জল ফেলে চলেছেন কুলীন ব্রাক্ষ্মণ মৌসুমী চ্যাটার্জি, দেবশ্রী এসেছেন সবার সামনে পিতৃঋণ শোধ করতে। তার বয়স হয়েছে বেশ। কিংবদন্তী অভিনেত্রী তরুণ মজুমদারকে হারানোর পর থেকে শরীরটি খারাপ হয়ে গিয়েছে। তিনি মানসিক বৈকল্যেরও শিকার হচ্ছেন। তাদের সিনেমা ভুবনের সাফল্যের কারিগর ৪ জুলাই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন কলকাতার একটি সরকারী হাসপাতালে। এরপর থেকে দেবশ্রীর প্রবল জ্বর, সর্দি, কাশিতেও ভুগছেন। তিনি জন্মদাতার মেয়ের মতো এর মধ্যে সব পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে চলেছেন, দেবশ্রীকে বিরক্ত করার সাহস এখন আর কারো নেই।
অত্যন্ত ঠান্ডা প্রকৃতির এই বিখ্যাত অভিনেত্রী আবার ফিরে এসেছেন কদিন আগেই পদায়, টিভি শো ‘সর্বজয়া’র মাধ্যমে। তবে সুখ তার কপালে সইলো না। সারাজীবন যাকে পিতার সম্মানে গুরু বলে জেনেছেন, তিনিই আর নেই। ‘তিনি কেবল আমাকে সাবসময় পথপ্রদর্শন করেননি, তিনি আমাকে নামটিও দিয়েছেন দেবশ্রী’-বলেছেন কিংবদন্তী অভিনেত্রী। গণমাধ্যমকে আরো বলেছেন, ‘কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, বলতে পারবো না। তিনি আমার বাবার মতো, যিনি আমাকে তৈরি করেছেন। তাকে আমি বাবা ও সাধনাদিকে মায়ের সম্মান দিয়ে চলেছি।’ এই কথাগুলো বলার সময়ও দেবশ্রী রায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। অত্যন্ত অসহায় দেখাচ্ছিল বাংলা ছবির অন্যতম কীর্তিমান অভিনেত্রীকে। তরুণ মজুমদারের চলে যাওয়ায় শোকের ছায়া নেমেছে সর্বভারতীয় সিনেমা ভুবনে। টালিগঞ্জ এখন কাঁদছে। সারা বিশ্বে তার গুণগ্রাহীরা এখন ব্যাকুল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তার শ্রদ্ধা প্রদশন করেছেন। অন্যরাও। প্রশেনজিৎ চ্যাটাজি, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত তাদের শোকাঞ্জলি জানিয়েছেন। এই ঋণ তাদের শোধ হবার নয়।
ছবি : পদায় তরুণ মজুমদারের তিন মেয়ে দেবশ্রী রায়, মহুয়া রায়চৌধুরী ও মৌসুমী চ্যাটার্জি।
ওএস।