জীবনের মঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন পিটার ব্রুক
পিটার ব্রুক, ব্রিটেনের যুদ্ধোত্তর সময় থেকে আজকে পর্যন্ত সবচেয়ে সৃজনশীল ও বিতর্কিত পরিচালকদের একজন আজ ৯৭ বছর বয়সে চলে গেলেন।
১৯৭৪ সাল থেকে তিনি ফ্রান্সে বাস করতেন। প্যারিসে মারা গিয়েছেন।
তার স্টেজ প্রডাকশনগুলোর মধ্যে আছে মঞ্চের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিয়োগান্তর, সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দর্শকদের সবাপেক্ষা কষ্ট দেওয়া নাটকগুলো।
তার ক্যারিয়ারে রয়েছে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটক, সঙ্গীত প্রযোজনা এবং সিনেমা ‘দি লর্ড অব দি ফ্লাইজ’র রূপান্তরও।
তার পুরো নাম পিটার স্টিফেন পল ব্রুক, ১৯২৫ সালের ২১ মার্চ পূর্ব লন্ডনে একটি ইহুদী অভিবাসী পরিবারে জন্মেছেন।
তার মঞ্চের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পর তার এই প্রতিভা দ্রুত আবিস্কৃত হলো।
মোটে ২০ বছর বয়সে তাকে বার্মিংহাম রিপাটোরি থিয়েটারে পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে।
২০ বছরের মাঝামাঝি মানে ২৫ বছর বয়সের দিকে তার জীবন পুরোনো জীর্ণ ব্রিটিশ থিয়েটারে আলো হিসেবে প্রতিভা ছড়াতে শুরু করলো। এরপর থেকে দশকের পর দশক ধরে ব্রুক অনেকগুলো চিরাচরিত রীতি ভেঙে ফেলেছেন।
তিনি দ্রুত রয়্যাল শেক্সপিয়ার কম্পানি (আরএসসি)তে যোগ দিলেন এবং এরপর চলে গেলেন দি রয়্যাল অপেরা হাউজে। সেখানে তিনি প্রডাকশনগুলোর পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৪০’র দশকের শেষের দিকে তার কাজের মধ্যে ছিল ‘লো বোয়েম’ ও ‘সোলোমি’।
এরপর তিনি নিউ ইয়র্কের দি মেট্রোপলিটন অপেরা হাউজের পরিচালক হয়েছেন।
তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ‘ব্রিটেনের যুদ্ধোত্তর মঞ্চ জগৎটি হয়ে পড়েছিল পুরোনো ফ্যাশনে চলা, বাঁধাধরা। পুরোনো ধারার কজন মানুষের হাতে চলত, যেখানে তারা শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো করতেন সবচেয়ে বোরিং উপায়ে। কল্পনার ছিটেফোঁটাও ছিল না।’
১৯৫০’র দশকে আরএসসির পরিচালক হিসেবে তিনি শেক্সপিয়ারের এই নাটকগুলো করেছেন তার সৃজনশীলতা ও দক্ষতার মাধ্যমে এবং ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা অভিনেতার অন্তর্ভুক্ত জন গিলগুড, পল স্কোফিল্ড ও লরেন্স ওলিভিয়েকে দিয়ে।
তিনি লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, প্যারিসসহ আরো অনেক মঞ্চে টিএস এলিয়ট, টেনেসি উইলিয়ামস, আর্থার মিলারের ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নাটকগুলো পরিচালনা করেছেন, শেক্সপিয়ারের নাটকগুলোর মতো।
এন্টোনেন আটোর ভাবনাগুলোর দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত ছিলেন। এই ভাবনায় মঞ্চকে নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করতেন তিনি।
তার প্রযোজনার মধ্যে আছে পিটার ভাইসের নাটক। তার ‘মারাট/শাডে’ নাটকটি আসলে লন্ডনে প্রদর্শিত হয়েছে। এরপর অন্য ব্রডওয়েগুলোতে গিয়েছে। এই নাটক ব্রুককে ১৯৬৬ সালের সেরা পরিচালকের টনি অ্যাওয়ার্ড এনে দিয়েছে।
১৯৭০ সালে আরএসসির জন্য একটি স্মরণীয়, আকাশপথে বাহিত ভার্সন করেছেন ‘শেক্সপিয়ারের অ্যা মিড সামার নাইটস ড্রিম’ নাটকে। ব্যবহার করেছেন শারিরীক করসত প্রদর্শনের জন্য ক্রীড়াবিদদের ব্যবহার করা ট্রপিজ ও রণ-পা। তাতে কল্পনা, পরীর উপস্থাপন করেছেন।
বিতর্ক তুলে তিনি ১৯৭০’র দশকে ইংরজ থিয়েটার ছেড়ে দেন ও প্যারিসে চলে যান। সেখানে তিনি ‘দি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিয়েটার রিসার্চ’ নামের একটি নিরীক্ষাধমী থিয়েটার কম্পানি গড়ে তোলেন।
নিজের কম্পানিটি নিয়ে তিনি বিশ্বের নানা দেশ ভ্রমণ করেছেন। নানা ধরণের মানুষের কাছে বিভিন্ন রকমের প্রযোজনা উপস্থাপন করেছেন। এমনকি মাদকাসক্ত এবং মানসিক রোগীদের জন্যও নাটক করেছেন।
ফ্রান্সে তার উল্লেখ্যযোগ্য ও স্মরণীয় নাট্য প্রদর্শনী আছে। আছে অষ্ট্রেলিয়া ও আমেরিকাতে। এই নাটকটির নাম হলো ‘দি কনফারেন্স অব দি বার্ডস’। একটি মধ্যযুগের পার্সিয়ান কবিতা থেকে তৈরি। অষ্ট্রেলিয়াতে তিনি একটি খনিতে নাটকটির প্রদর্শনী করেছেন।
তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হলো ‘দি মহাভারত’। একটি নয় ঘন্টার সংস্কৃত এপিক, ধমগ্রন্থের নাট্যরূপ। ১৯৮৮ সালে গ্লাসগোতে নিয়ে আসার আগে কটি দেশে পর, পর প্রদর্শনী করেছেন।
তিনি কয়েকটি ছবিও করেছেন। নির্মাণ করেছেন ১৯৬৩ সালে সেই ‘দি লর্ড অব দি ফ্লাইজ’। এটি ছাড়াও তার বানানো ‘দি ট্রাজেডি অব কারমেন’ ছবিটিকেও মঞ্চে নিয়ে এসেছেন। নাটকটি কটি পুরস্কার জয় করেছে।
তিনি নিজের শেক্সপিয়ারের নাটক ‘কিং লিয়ার’কে সিনেমাতে রূপান্তর করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি দিয়েছেন হলে। ছবিতে অভিনয় করেছেন পল স্কোফিল্ড।
২০১২ সালে তাকে নিয়ে ছেলে সাইমন ‘দি ট্রাইটোপ’ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন। এখানে তার নাট্য পরিচালনার স্টাইলও তুলে এনেছেন। এছাড়াও গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করতেন তিনি, যাতে অভিনেতা, অভিনেত্রীরা কোনোভাবে বিরক্ত না হন।
তিনি তার পাত্র, পাত্রীদের একটি কল্পনার কার্পেটের ওপর দিয়ে চালানোতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাদের কল্পনাশক্তিকে ব্যবহার করতেন। তাদের আকাশে তুলে দিতে অভ্যস্থ ছিলেন।
তার সম্পর্কে বলা হয়, তিনি আইডিয়ার প্রতি যেকোনোকিছুর চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। দশকদের আঘাত বা হতবুদ্ধ করতে অভ্যস্থ ছিলেন। অন্তর্দৃষ্টি, অনুভূতি, প্রজ্ঞা ও নির্লজ্জ সাহসের তিনি অসাধারণ সম্মিলনে তৈরি একজন বিখ্যাত মঞ্চ নাটকের পরিচালক ছিলেন।
১৯৫১ সালে অভিনেত্রী নাতাশা প্যারিকে বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রী ২০১৫ সালে মারা গিয়েছেন।
ওএস।