৮১-তেও অনবদ্য ফেরদৌসী রহমান
বাংলা গানের জীবন্ত এক কিংবদন্তি শিল্পী ফেরদৌসী রহমান। গত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা গানকে যিনি সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন। বাংলা গানের সব শাখাতেই রয়েছে তার বিচরণ। বাবা কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিন। বাবার মুখ উজ্জ্বল করে তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্য এক গানের পাখি। কেবল গায়িকাই নন, গানের শিক্ষকও তিনি।
মঙ্গলবার (২৮ জুন) কিংবদন্তি এই গায়িকার জন্মদিন। আজ জীবনের ৮১তম বসন্তে পা রাখলেন তিনি। ১৯৪১ সালের ২৮ জুন পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে জন্ম নেন এই তারকা।
বাবা পল্লিগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের কাছেই তার গানের হাতেখড়ি। পরবর্তী সময়ে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ইউসুফ খান কোরেইশী, কাদের জামেরী, গুল মোহাম্মদ খানের মতো সংগীতজ্ঞের কাছে তালিম নিয়েছেন তিনি।
মাত্র ৮ বছর বয়সে ১৯৪৮ সালে রেডিওতে ‘খেলাঘর’ নামের অনুষ্ঠানে অংশ নেন ফেরদৌসী রহমান। সে সময় তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। ১৯৫৬ সালে প্রথম বড়দের অনুষ্ঠানে গান করেন এই শিল্পী। ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন রেজাউর রহমানকে। বিয়ের পরই ফেরদৌসী বেগম থেকে তিনি হলেন ফেরদৌসী রহমান।
১৯৬০ সালে ‘আসিয়া’ চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম সিনেমার গানে কণ্ঠ দেন। এই সিনেমা মুক্তির আগেই মুক্তি পায় ‘এ দেশ তোমার আমার’ সিনেমাটি। এতে তিনি গেয়েছিলেন- ‘চুপিসারে এত করে কামিনী ডাকে’। এর পর থেকে ফেরদৌসী রহমান একে একে উপহার দেন ‘সাতটি রঙের মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই’, ‘যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে’, ‘আমি কার জন্য পথ চেয়ে রব’, ‘মনে যে লাগে এত রঙ ও রঙিলা’, ‘নিশি জাগা চাঁদ হাসে কাঁদে আমার মন’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি’, ‘ঝরা বকুলের সাথী আমি সাথী হারা’, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘পদ্মার ঢেউরে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান।
বলতে গেলে ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সিনেমায় ফেরদৌসী রহমানের গান ছাড়া কিছু কল্পনাই করা যেত না। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তার গানের মাধ্যমেই বাংলাদেশ টেলিভিশন উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম প্রচারিত গান ছিল তার গাওয়া ‘ওই যে আকাশ নীল হলো আজ সে শুধু তোমার প্রেম’।
১৯৬০ সালে ফেরদৌসী রহমান ইউনেস্কো ফেলোশিপ পেয়ে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে ৬ মাসের সংগীতের ওপর স্টাফ নোটেশন কোর্স সম্পন্ন করেন। প্রথম সুরকার হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ১৯৬১ সালে ‘রাজধানীর বুকে’ সিনেমার মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর ফেরদৌসী রহমান ‘মেঘের অনেক রং’, ‘গাড়িয়াল ভাই’ এবং ‘নোলক’ সিনেমায় সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।
বিটিভির জনপ্রিয় শিশুতোষ অনুষ্ঠান ‘এসো গান শিখি’ দিয়ে সবার কাছে ‘খালামণি’ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। মাঝে কিছুদিন তার শারিরীক অসুস্থতার জন্য এই অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। আবারও তিনি ফিরেছেন এই অনুষ্ঠানে।
বাংলা ছাড়াও গেয়েছেন উর্দু, ফারসি, আরবিসহ বেশ কিছু ভাষার গান। ফেরদৌসী রহমান অবসরে আত্মজীবনী লিখছেন। বিটিভির ‘এসো গান শিখি’র অনুষ্ঠানটি আবার নিয়মিতভাবে রেকর্ড করছেন।
গানের মাধ্যমে দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন এই কিংবদন্তি। এরমধ্যে রয়েছে লাহোর চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার (১৯৬৩), সর্বকনিষ্ঠ সংগীতশিল্পী হিসেবে প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৬৫), টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৫), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৭৬), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক, ১৯৭৭), একুশে পদক (১৯৭৭ সাল)। আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ (২০১৫) এক জীবনে দেশ-বিদেশে আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন ফেরদৌসী রহমান।
জন্মদিন নিয়ে ফেরদৌসী রহমান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আমার বাবা আব্বাসউদ্দীন আহমদকে কয়জন মনে রাখছে? আর আমার জন্মদিন মনে রেখেই কী হবে? যতদিন জীবিত আছি ততদিনই মানুষ মনে রাখে। চলে গেলে সেই মানুষকে আর মনে রাখে না। রাষ্ট্র আমার বাবাকে সেই সম্মান দিতে পারেনি। আমিও চলে যাব, ফেরদৌসী রহমানকেও কেউ মনে রাখবে না। তবে অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, এই ভালোবাসা নিয়েই চলে যেতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘পারিবারিকভাবে আমার জন্মদিন ঘটা করে উদযাপন করা হয় না। আমার জন্মদিন বাবা একবারই খুব ঘটা করে উদযাপন করেছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করার পর। সে জন্মদিনে অনেক কবি সাহিত্যিক লেখকরা এসেছিলেন। এরপর আর উৎসব করে জন্মদিন পালন করিনি। তবু বাইরে অনুষ্ঠান থাকলে ভিন্ন কথা। এ ছাড়া অন্য দশ দিনের মতোই দিনটি আমার কেটে যায়।’
এএম/এমএমএ/