‘সম্মানসূচক’ অস্কারজয়ী প্রথম নারী চলচ্চিত্র পরিচালক
কান চলচ্চিত্র উৎসবের এই ৭৫তম বাষিকীতে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে, “দি স্যাল ডু সোয়ারানটিমি’ পুরস্কারটির নামকরণ করা হবে ‘স্যাল অ্যাগনেস ভার্ডা’।” নামটি তাদের ২০০৭ সালের উৎসবে ৬০তম বাষিকীতে রাখা হয়েছিল। এখন কানের হিরকজয়ন্তী চলছে।
‘আমি কেবল প্রদর্শন করতে চাইনি, চেয়েছি মানুষকে দেখতে আগ্রহী করতেও’, তিনি বলেছেন। অ্যাগনেস ভার্ডা লাভ করেছেন “অনারারি পাম দ’র” বা ‘সম্মানসূচক স্বর্ণ পাম’। তখন তার কান কলচ্চিত্র উৎসবের অফিশিয়াল পোস্টারে লেখা ছিল-“অ্যাগনেস ভার্ডার সিনেমা জীবন ছিল অনুরাগ, মমতা ও অপকারের। তার জীবনের ‘৬৫ বছর’ কেটেছে নির্মাণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। এই জীবন কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রায় সমান। এই উৎসব তার মতোই এক দৃষ্টিতে দেখে, জীবনগুলোকে ভালোবাসে এবং তেমনভাবে জানে কীভাবে মনে করতে হয়।”
যাকে নিয়ে কানের এমন প্রশংসাবচন, সেই অ্যাগনেস ভাডা এখন আর নেই। জন্মেছিলেন ১৯২৮ সালের ৩০ মে। মারা গিয়েছেন ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ। আজ থেকে মোটে তিন বছর আগে। বেঁচেছিলেন অনেকদিন, তার ছবির মতোই মোট ৯০টি বছর। আসল নামটি তার হারিয়ে গিয়েছে আলোকচিত্র জগতের নামে-‘আলেট ভার্ডা’। তিনি জন্মেছিলেন বেলজিয়ামে। ছিলেন একজন ফরাসী নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, আলোকচিত্রী ও শিল্পী। ১৯৫০ ও ষাটের দশকের ফরাসী নতুন চলচ্চিত্রের ঢেউ আন্দোলনের প্রভাব বিস্তৃতভাবে এই দুনিয়াতে ছড়িয়েছে। চলচ্চিত্র আন্দোলনটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন এই নারী। এই তার বর্ণাঢ্য ও বহুল স্বীকৃত কাজ। তিনি সিনেমা বানিয়েছেন বাস্তবতা, নারীদের নারা সংকট ও সমাজের সমস্যাগুলোতে তুলে আনার দালিলিক প্রমাণাকারে। সেগুলো হয়েছে প্রামাণ্যচিত্রও, সবগুলো তিনি জোর দিয়ে তৈরি করেছেন। কাজে অ্যাগনেস ভার্ডা একটি নিরীক্ষাধমী ও আলাদা স্টাইলের বয়ান রেখে গিয়েছেন। কাজ করেছেন লোকেশন শুটিং স্টাইলে। ফলে শব্দ প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার যুগকে উৎরে গিয়েছেন। এর বাদেও তিনি অ-পেশাদার অভিনেতা, অভিনেত্রীদের নিয়ে চরিত্রায়ণ করেছেন। এও ছিল ৫০’র দশকের ফরাসী চলচ্চিত্রের রীতিবিরুদ্ধ।
অ্যাগনেস ভার্ডার ক্যারিয়ারের শুরু হলো ১৯৫৫ সালে। যখন তার প্রথম ছবি, ‘লা পয়েন্ট কোট’ বেরুলো। এরপর তিনি আরো বানালেন ‘ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭’। এই ছবিকে বর্ণনারীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবি, তার জীবনেরও এমন ধারার সেরা হিসেবে মান্য করা হয়। ছবিটি ১৯৬২ সালের। আরেকটি সেরা ছবি ১৯৮৫ সালের ‘ভ্যাগাবন্ড’। ১৯৮৮ সালের ‘কুং ফু মাস্টার’ আছে।
তিনি প্রামাণ্যচিত্রকার হিসেবেও অত্যন্ত সম্মানীয়। ১৯৬৮ সালে বানিয়েছেন ‘ব্ল্যাক প্যানথার্স’। ২০০০ সালে মুক্তি পেয়েছে ‘দি গ্লিনার্স অ্যান্ড আই’। আট বছর পরের ছবি ‘বিচার্স অব অ্যাগনেস’। মারা যাবার মোটে দুই বছর আগের প্রামান্যচিত্রটি হলো ‘ফেইসেস প্লেসেস’। আর জীবনের শেষ বছরে বেরিয়েছে তার ‘ভার্ডা বাই অ্যাগনেস’।
বিশ্বখ্যাত মাকিন পরিচালক মাটিন স্করসেইজি তাকে ‘সিনেমার অন্যতম ঈশ্বর’ স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি “অনারারি পাম দ’র” ও ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের ‘গোল্ডেন লায়ন’ জয় করেছেন। অস্কারে তিনি ‘অ্যাকাডেমি অনারারি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন। বিশ্বের প্রথম নারী চলচ্চিত্রকার হিসেবে সম্মানসূচক অস্কারটি দেওয়া হয়েছে তাকে। মনোনীত হয়েছিলেন ‘দি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ডকুমেন্টারি ফিচার’র জন্য। তখনো তিনি সবার বড় বয়সে।
তবে অ্যাগনেস ভার্ডা বলেছেন, ‘আমি একজন নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা নই, একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাই।’ প্রায়ই ফরাসী এই চলচ্চিত্রকার তার ছবিগুলোর শুভমুক্তি ও প্রদর্শনের জন্য কানে আসতেন। ফলে ৩০ বার তার ছবি আনুষ্ঠানিক বাছাইয়ে গিয়েছে। ২০০৫ সালের আসরে বিচারকদের অন্যতম ছিলেন। “ক্যামেরা দ’র” বিচারক দলের সভাপতি ছিলেন ২০১৩ সালে। কান চলচ্চিত্র উৎসব তাকে ২০১৫ সালে “অনারারি পাম দ’র” বা ‘সম্মামসূচক স্বণ পাম’ নামের সেরা পুরস্কারটি প্রদান করে নিজেরাও সম্মানিত হয়েছে। অ্যাগনেস ভার্ডাকে নিয়ে তখন কান চলচ্চিত্র উৎসব লিখেছে, ‘প্রতিরোধ আন্দোলনের পুরোধা ও ধৈয্যের প্রতিমূর্তি। তিনি এই সম্মানের উধ্বে।’ তিনি তার স্বর্ণ পামকে উৎসর্গ করেছেন, ‘সারা বিশ্বের সব উদ্ভাবক, উৎসাহী চলচ্চিত্রকারের প্রতি। যারা সত্যিকারের ফিকশন বা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন। যারা আলোর নীচে নেই কিন্তু সেই আলোর মশালগুলোকে বয়ে বেড়ান-তাদের সবার উদ্দেশ্য।’
‘স্যাল অ্যাগনেস ভার্ডা’ নামের চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন বাদেও কান তার নামে উৎসবস্থলের একটি কক্ষের নামকরণ করেছে। সেটি ‘দি শ্যালে অ্যাগনেস ভার্ডা’। রুমের নামটি আগের পুরস্কারের নামেই ছিল ‘দি স্যাল ডু সোয়ারানটিমি’। এখান থেকেই পুরস্কারটি প্রদান ও বাছাই চলে।
অ্যাগনেস ভার্ডার ছেলেমেয়ে রোজালি ভার্ডা ও ম্যাথিউ ভাডা মাকে এমন সম্মান জানানোয় বলেছেন, “আমরা গর্বিত। কান চলচ্চিত্র উৎসব আমাদের মায়ের নামে পুরস্কার ও বিশেষ কক্ষের নাম প্রবর্তন করায় এই আসরের উৎকষ বাড়ালো। আমাদের মা ও এই উৎসব একটি দীর্ঘকালের গল্পকে পাশাপাশি বয়ে বেড়িয়েছেন। কানে অ্যাগনেস ভার্ডার শুরু ১৯৬২ সালে, তার বিশ্বখ্যাত বর্ণনারীতির অন্যতম স্বাক্ষ্য ‘ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭’র মাধ্যমে। একটি রূপকথা তৈরি করেছেন তিনি ‘দি আম্বেলাস অব চিয়ারবর্গ’র মাধ্যমে। এই ছবিটির জন্য আমাদের বাবা জ্যাকুয়েস ডেমি ১৯৬৪ সালে “পাম দ’র” বা ‘স্বর্ণ পাম’ জয় করেছেন। ২০১৭ সালে আমাদের মায়ের ‘জে আর’ নামের ফরাসি আলোকচিত্রী ও পথের শিল্পীর সঙ্গে যৌথভাবে, প্রধান ভূমিকায় বানানো ‘ফেইসেস প্লেসেস’ লো’য়ি দ’ নামের প্রামাণ্যচিত্র শাখার কানের সেরা পদকটি জয় করেছে। আমরা ভুলিনি, সেই জাদুকরী রাতটিও, যেদিন তাকে “পাম দ’র” প্রদান করা হলো। আমাদের সব স্মরণীয় সময়গুলো মনে আছে। তার ছবিগুলো, ছবির জগতের পরিবার-সবাই আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কান চলচ্চিত্র উৎসব দীর্ঘজীবি হোক। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও এই আন্দোলন চিরস্থায়ী হোক।”
অ্যাগনেস ভার্ডা ১৯৮৩ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের বিচারকদের অন্যতম ছিলেন। এই ভেনিসেই তিনি ১৯৮৫ সালে জয় করেছেন ভ্যাগাবন্ডের জন্য সেই সেরা পুরস্কার দি গোল্ডেন লায়ন। এটি ছিল ৪২তম আসর। তিনি ২০০২ সালে লাভ করেছেন ‘দি ফেঞ্চ অ্যাকাডেমি প্রাইজ’। ২০০৭ সালের ৪ মাচ ফ্রান্স সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অ্যা গ্রান্ড অফিসার অব দি ন্যাশন্যাল অর্ডার অব দি মেরিট অব ফ্রান্স’ নিযুক্ত করেছে। আজীবন তিনি এই স্বীকৃতি ও দায়িত্ব উন্নতিতে পালন করেছেন। ২০০৯ সালে অস্কারের ৩৪তম আসরে তার ‘দি বিচেজ অব অ্যাগনেস’ জয় করেছে সেরা প্রামাণ্যচিত্র পদক। ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল তিনি ফ্রান্সের “কমান্ডো ডে লা লেজিওন ডো’নার” পদোন্নতি লাভ করেছেন। ২০১০ সালের মে মাসে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রযোজনায় তার অনমনীয়তার জন্য আজীবনের সম্মাননা “ক্যারোসেই দ’র” প্রদান করা হয়। তার জন্মস্থানের ইউনিভাসিটি অব লি’জ তাকে সম্মানসূচক সম্মাননাও প্রদান করেছে। এটি ফরাসি সমাজভুক্ত বেলজিয়ামের অন্যতম সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়।
২০১৩ সালের ১৪ মে অ্যাগনেস ভার্ডা ‘দি ন্যাশনাল অডার অব মেরিট অব ফ্রান্স গ্রান্ড ক্রস’ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। সেই বছরের ২২ মে তিনি চলচ্চিত্র সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘এফআইএএফ (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম আর্কাইভস) অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ২০১৪ সালের ১০ আগষ্ট তিনি ‘দি লেপার্ড অব অনার’ লাভ করেন সুইজারল্যান্ডের সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার আন্তজাতিক-‘দি লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসব’-এ। ৬৭ তম এই আসরের ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় নারী চলচ্চিত্রকর্মী। সে বছরের ১৩ ডিসেম্বর ইউরোপীয়ান ফিল্ম অ্যাকাডেমি তাকে ‘আজীবন অর্জন সম্মাননা’ প্রদান করে। ২০১৫ সালের ২৪ মে লাভ করেছেন কানের ‘স্বর্ণ পাম’টি। তিনিই প্রথম নারী হিসেবে সম্মানটি লাভ করেছেন। ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল ফ্রান্সের ‘দি গ্রান্ড অফিসার দে লা লেজিয়ন দ’অনার’ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। এটিই তার দেশের যেকোনো মানুষের সামরিক ও বেসামরিক শাখার সেরা পুরস্কার। “দি সিনেমা আই’জ” তাকে ‘আনফরগেটেবল’ বা কোনোদিনও ভোলা যাবে না তালিকাতে ২০১৭ সালে অন্তর্ভুক্ত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের পশ্চিম অংশের কুইন্সের ‘দি মিউজিয়াম অব মুভিং ইমেজ’ তাকে এই সম্মানটি প্রদান করে। ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর অ্যাগনেস ভার্ডা ‘সম্মানসূচক অস্কার’টি জয় করেন। সিনেমাতে তার আজীবনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ও প্রধানত চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে নবম অ্যানুয়াল গভনরস অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে অস্কারটি দেওয়া হয়েছে। তিনিই সবচেয়ে বয়সী ব্যক্তিত্ব ও প্রথম নারী চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেব জয় করেছেন। উপস্থাপনা করেছেন বিশ্বখ্যাত নায়িকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। ২০১৯ সালে বিট্রিশ বিশ্ববিখ্যাত গণমাধ্যম বিবিসি যে ৮৪টি দেশের ৩শ ৬৮ জন চলচ্চিত্র পারদশীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, নারীদের তৈরি সেরা ১শ ছবির তালিকা তৈরি করে দিতে, তাতে সবার সেরা হয়েছিলেন ও সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন তিনি। তালিকাতে এসেছে তার সাতটি ছবি। সবার চেয়ে বেশি। ‘দি বিচেজ অব অ্যাগনেস’, ‘ওয়ান সিংস’, ‘দি আদার ডাজন্ট’, ‘দি গ্লিনার্স অ্যান্ড আই’, ‘লু বুনো’ ও ‘ভ্যাগাবন্ড’। তার আরেকটি ছবি ‘ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭’ হয়েছে তালিকার দুই নম্বর সিনেমা।
ছবি: অবিশ্বাস্য রূপবতী অ্যাগনেস ভার্ডা, কানে তার নিজের হাতে করা হাতের ছাপ, কান চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি ও স্বামীকে নামে তার নামে বিশেষ পোষ্টার, একসঙ্গে তারা দুজনে, শেষ বয়সে ক্যামেরায় শুটিং করছেন, মধ্যবয়সে স্বামীর সঙ্গে ক্যামেরায় শুটিং করছেন, একটি বিশেষ পোট্র্র্রেট, যৌবনে ক্যামেরার পাশে।