সত্যজিৎ রায়ের জন অরণ্যের ‘সোমনাথ’ চলে গেলেন
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা শহরে আজ ২৯ আগস্ট, কিংবদন্তী বাঙালি অভিনেতা প্রদীপ মুখার্জি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন। তিনি নায়ক চরিত্রে অভিনয় করে অমর হয়ে থাকবেন সত্যজিৎ রায়ের ‘জন অরণ্যে’ ছবিতে। জনপ্রিয় ও ভিন্ন ধারার সাহিত্যিক শংকরের জন অরণ্যেকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালে বেরুনো এই ছবিতে সত্যজিৎ। তার কলকাতা ট্রিলজি বা তিনটি ছবির একটি পূর্ণ গল্পের সিরিজের এই হলো শেষ ছবি। আগের দুটি হলো ‘প্রতিদ্বদ্বী’, ১৯৭০ সালে বেরিয়েছে; ১৯৭১ সালের সিনেমা তার ‘সীমাবদ্ধ’। সিরিজের শেষ ছবিতে ক্লাসিক সত্যজিৎ তুলে এনেছেন ১৯৭০’র দশকের ভারতের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর তরুণদের নানা অথনৈতিক সংকট ও সংগ্রাম।
প্রদীপের ভালো নাম প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। জন্মেছেন দেশভাগের দুটি বছর আগে, তুমুল হিন্দু, মুসলাম ও অন্যান্য শ্রেণীর ওলটপালট জীবনে। ১৯৪৬ সালের ১১ আগস্ট। তিনি নাটকেও অভিনয় করেছেন, মঞ্চে গিয়েছেন। তবে তিনি মূল ধারার অন্য ছবিগুলোতে জন অরণ্যের মতো খ্যাতি লাভ করেননি। তবে মোটেও অখ্যাত থাকেননি। তার বিখ্যাত ছবিগুলোগুলো-বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘দূরত্ব’-১৯৮১ সালে বেরিয়েছে ও এই সময়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’, মুক্তি পেয়েছে ২০০১ সালে।
যে মধ্যবিত্তের সংগ্রাম তিনি তার তরুণ কালে তুলে এনেছেন পুরো ভারতবর্ষের ছেলেমেয়েদের জীবনগল্প সিনেমার পর্দায়, তেমনই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছেন প্রদীপ। অবশ্য ভারতের বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশ কলকাতা শহরেই, ব্রিটিশদের হাত ধরে। তার বাবা ছিলেন শ্রী মোহন মুখোপাধ্যায় আর মা ভক্তি মুখোপাধ্যায়। তারা কুলীন ব্রাক্ষ্মণ পরিবার। তিনি বেড়ে উঠেছেন চোরবাগানে, শিমলায়। বহু পুরোনো হেয়ার স্কুল থেকে প্রদীপের মাধ্যমিক। ১৯৬৫ সালে পাশ করা এই ভালো ছাত্র এরপর কলকাতা সিটি কলেজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সত্যজিতের ছবিতে কাজের মাত্র তিনটি বছর আগে ১৯৭৩ সালে পাশ। তিনি আইনে বিএ।
কলেজে পড়ার সময় থেকে আটপৌঢ়ে পরিবারের ছেলেটি গলায় গামছা ফেলে নাটকে চলে গেলেন। সেখানে তিনি অভিনয়ের বিদ্যালয়ে পড়েছেন। তার পড়ালেখা তপন থিয়েটারে। কলকাতা শহরেই। আইনে পাশ করে অবশ্য পরিবারের চাহিদা মেটাতে চলে গেলেন ওকালতির পেশায়। তবে অভিনয়ের পোকা তাকে কুঁড়ে, কুঁড়ে খেয়েছে। ছুটির দিনগুলোতে, অবসরে তিনি অভিনয়ে মেতে থাকতেন। মনের ও সংস্কৃতির ক্ষুধা মেটাতেন। কচিৎ পয়সা কড়ি আসতো।
এর মধ্যে জীবনের বাঁক বদলে গেল প্রদীপের সত্যজিতের দেখা পেয়ে। উপেন্দ্র কিশোরের নাতি ও সুকুমার রায়ের একমাত্র সন্তান সুবিখ্যাত, অনন্য মেধাবী সত্যজিৎ রায় ও প্রদীপ মুখার্জি মুখোমুখি হলেন ১৯৭৪ সালে। তার অভিনয় দেখে খুব খুশি বাঙালি বিশ্বখ্যাত সিনেমা মেকার। তখন নকশা তারা থিয়েটার দলে অভিনয় করছিলেন প্রদীপ। ফলে তিনি নায়ক পেয়ে গেলেন তার জন অরণ্যের জন্য। ছবিটি প্রদীপ মুখার্জিকে ১৯৭৬ সালের পূবের সেরা অভিনেতা বা ‘বেস্ট অ্যাক্টর ফর ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ইস্ট’ এনে দিল। এছাড়াও তিনি অসাধারণ সম্মান লাভ করলেন ১৯৪৮ সাল থেকে চেক রিপাবলিকের দেওয়া ‘কারলভি ভারি শহরে ‘ক্রিস্টাল গ্লোব’ নামে খ্যাত সিনেমা পুরস্কারটি লাভ করে। ‘কারলভি ভারি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’র প্রধান পুরস্কার। মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপের সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত, বিশ্বের অন্যতম পুরোনো চলচ্চিত্র পদক।
জন অরণ্য বেরুনোর পর জীবনটি পুরোপুরি বদলে গেল প্রদীপের। পরের বছর ১৯৭৭ সালে তিনি বিয়ে করলেন। তার একটি ছেলে ও মেয়ে আছে। আয়কর আইন বিশেষজ্ঞ প্রদীপ মুখার্জিকে ওকালতি ব্যবসাও চালিয়ে যেতে হয়েছে। কলকাতার পূবের অংশ লেক টাউনের পতিপুকুরে তার নামকরা চেম্বার ছিল।
তবে অভিনয় কম করেননি এই সুবিখ্যাত ও ভালো অভিনেতা। মোট ৪০টি ছবি তার। এর মধ্যে ১৯টি সুপারহিট। এই তিনি চলে গেলেন আজ ২৯ আগস্ট কলকাতার একটি হাসপাতালে। পরিবার জানিয়েছে, তিনি ছিলেন ৭৬। তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও তাদের পরিবার রেখে গিয়েছেন।
তারা বলেছেন, একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল তিন দিন আগে এই সিনেমা ও টিভি তারকাকে ফুসফুসে প্রদাহের জন্য। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য চলে যেতে হয়েছে একটি রাজ্য হাসপাতালে। তবে জীবনপ্রদীপ থাকেনি বরেণ্য এই কীর্তিমানের। সেখানে তার অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে এবং সকাল আটটা ১৫ মিনিটে প্রাণবায়ু নিভে দিয়েছে জন অরণ্যের নায়কের।
শক্তিমান, বিখ্যাত অভিনেতা প্রদীপ মুখার্জিকে হারিয়ে কাঁদছে পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ভুবন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন বাংলায় একটি রাষ্ট্রীয় শোকবাণীতে, ‘হঠাৎ পেলাম প্রদীপদার মৃত্যুর খবর। তিনি তার অভিনয়ের সীমা এবং সকল প্রশংসার উর্ধ্বে উঠেছেন ওই তিনটি ছবিতে। প্রদীপ মুখার্জির মৃত্যু একটি গভীর শূণ্যতা তৈরি করল।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার শোক তার পরিবারের প্রতি তার গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন ও ভক্তদের মিছিলে শামিল হয়েছেন।
প্রদীপ মুখার্জির বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে আছে-১৯৯২ সালের ‘হীরের আংটি’, বানিয়েছেন ঋতুপর্ণ। ২০০২ সালে তাকে নিয়ে বানিয়েছেন কীর্তিমান-বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’। তার এই প্রতিটি ছবিই ইংরেজি সাব-টাইটেলে বিশ্বের নানা দেশে উৎসব ও হলে প্রদর্শিত হয়েছে। জন অরণ্যে তার চরিত্রটি বিখ্যাত ‘সোমনাথ’।। প্রধান ও মূল চরিত্র।
শেষ অভিনয় করেছেন এই দুঁদে অভিনেতা গেল বছর দেব রায় পরিচালিত ‘তরুলতার ভূত’। ফলে সারাজীবনই তিনি অভিনয় করে গিয়েছেন ভালোবেসে। তার মৃত্যুর পর প্রেস ট্রাস্ট্র অব ইন্ডিয়া (পিটিআই)কে সত্যজিতের ছেলে ও বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সন্দীপ রায় বলেছেন, “বাংলা সিনেমার ভুবনে তিনি আমার বাবা সত্যজিৎ রায়ের মাধ্যমে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। প্রদীপদাকে একটি মঞ্চ নাটকে দেখে সত্যজিৎ রায় আটকে গিয়েছেন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, জন অরণ্যের নায়ক করবেন। অসাধারণ ও অনবদ্য অভিনয় করেছেন তিনি সিনেমাটিতে। কেবল তাই নয়, সত্যিকারের একজন শুভাকাংখী ছিলেন প্রদীপ মুখার্জি ‘রায় পরিবার’-এর। আমাদের অনেক আপদে, বিপদে তিনি ছায়া হয়েছেন। ফলে আমরা একজন পরিবারের সদস্যকে আজ হারালাম।”
সত্যজিৎ রায়ের ১৯৯০ সালের ছবি ‘শাখা-প্রশাখা’ সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন প্রদীপ মুখার্জি। তার ছেলে সন্দীপ রায়ের তিনটি ছবির তিনি অন্যতম সেরা অভিনেতা। ২০১০ সালের ‘গোরস্থানে সাবধান’, ২০১২ সালের ‘যেখানে ভূতের ভয়’, ‘বাদশাহী আংটি’-২০১৪, ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।
জীবদ্দশায় একটি মাত্র ছবি প্রদীপ মুখার্জির হিন্দি সুজয় ঘোষের ‘কাহিনী ২: দুর্গা রাণী সিং'। ছবিটি ২০১৬ সালে হলে, হলে গিয়েছে।
সম্প্রতি প্রদীপের অন্যতম ছবি হলো-নির্মল চক্রবর্তীর দীর্ঘদিন দেরী করে বানানো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই ‘দত্তা’ উপন্যাস অবলম্বে বানানো ছবিটি। এই ‘দত্তা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ছবিটির নায়ক বাংলাদেশের ‘ফেরদৗস’।
এই নামী পরিচালক বলেছেন, ‘প্রদীপদা বিশ্ব থেকে চলে গেলেন। তিনি একজন মাটির মানুষ ছিলেন। ভদ্রলোক ও সাংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ভালো স্বাস্থ্যের মানুষ ছিলেন না। তবে সব সামলেছেন তার অভিনয়ের প্রতি তুমুল নিবেদন ও ভালোবাসা দিয়ে। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি তার অভিনয় দিয়ে মানুষকে খুশি করতে চাইতেন। সবসময় আমি তার অভিনয়ে সন্তুষ্ট কী-না জানতে চাইতেন।’
ছবি : জন অরণ্যে সোমনাথ ও গুরু সত্যজিতের সঙ্গে ছবিটির শুটিংয়ে।
ওএফএস।