চলে গেলেন পাকিস্তানের ‘মেলোডি কুইন নাইয়ারা নূর’
পাকিস্তানের ‘মেলোডি কুইন’ নাইয়ারা নূর। সীমান্তের দুই পাশেই পূজিত। তিনি আর নেই। চলে গিয়েছেন ২০ আগস্ট, ২০২২ সালে।
পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী ও দেশের সবচেয়ে বড় শহর করাচিতে শেষ বিদায় নিয়েছেন। তিনি ভারত ও পাকিস্তানের লাখ লাখ মানুষকে তার ভক্ত করেছেন গভীর ও ভাবপূর্ণ সুর ও সংগীতে।
তিনি মৃত্যুর আগে স্বল্পকালের জন্য রোগে ভুগেছেন। তার পরিবার রবিবার জানিয়েছে তার চলে যাবার খবর, ‘ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করা শেষ সঙ্গীত আইকনদের একজন ছিলেন নাইয়ারা নূর। তিনি জীবনের শেষ দিকে বেশ কবার চিকিৎসা নিয়েছেন করাচিতে।’
তার আত্মীয় রাজা জায়িদী বলেছেন টুইটারে গভীর বেদনার সঙ্গে, ‘আমি আমার খালা নাইয়ারা নূরের চলে যাওয়ার কথা ঘোষণা করছি। তার আত্মা শান্তিতে ঘুমাক।’
‘তিনি একটি ঈর্ষনীয় উত্তরাধিকার তৈরি করেছেন এবং রেখে গিয়েছেন সেখানে সুমিষ্ট উপস্থাপনার বিপুল গুপ্তধন।’
নাইয়ারা নূর একজন প্লেব্যাক গায়িকা ছিলেন। প্রশান্ত ধরণের গায়িকা। তিনি ছিলেন খুঁতখুঁতে। প্রথম থেকে তার গানের উচ্চমান বজায় রেখেছেন। ১শর বেশি গান রেকর্ড করা আছে তার পাকিস্তানের সিনেমাগুলোতে। তিনি উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পীদের একজন বিবেচিত ছিলেন। পাকিস্তান টিভির শো গুলোতে ‘লাইভ গজল’ অনুষ্ঠানগুলোর জন্য অত্যন্ত পরিচিত ছিলেন। তিনি পুরো দেশের কনসাট হলগুলোতে পারফম করতেন।
তিনি জন্মেছেন ভারতের আসাম প্রদেশের ব্রক্ষ্মপুত্র নদের ধারের আঁকা-বাঁকা শহর গৌহাটিতে। ১৯৫০ সালের ৩ নভেম্বর।
নাইয়ারা নূরের ব্যবসায়ী বাবা ছিলেন অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের অন্যতম সমর্থক ছিলেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগের উত্তাল সময়ে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করতে আসামে এসেছেন, তার বাবা সেই বিরাট সমাবেশে উপস্থাপক ও অন্যতম সংগঠক ছিলেন।
এরপর দেশ ভাগ হলো। হিন্দু, মুসলমানের হানাহানি ও বিববাদ তাদের ঘিরে ধরেছে। ফলে ১৯৫৮ সালে তাদের পরিবার শেষ ঠিকানা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হলো। শরণার্থী হিসেবে চলে গেল পাকিস্তানের পাঞ্জাবে।
নাইয়ারা নূরের মৃত্যুর খবর জানিয়ে পাকিস্তানের অন্যতম সংবাদ মাধ্যম ডন তার একটি জীবন থেকে একটি উদ্বৃতি উল্লেখ করেছে, ‘শিক্ষা অর্জন আমাদের সব ধরণের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ছিল কিন্তু সঙ্গীত ছিল বিনোদনের সবচেয়ে বড় উৎস।’
নাইয়ারা নূর কবুল করেছেন যে ‘তাদের প্রজন্মের সব সময়ের প্রিয় ছিলেন কানন বালা ও বেগম আখতার। লতা মুঙ্গেশকর ছিলেন তাদের সবার কাছে একটি আবেগ।’
তবে এই মানুষটির কিন্তু শুরুতে গানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। গানকে ভালোবেসে শেখাই তার জীবনের ধরণ। তিনি বেগম আখতারের গজলগুলোতে মোহিত হয়ে গান শেখার শুরু করলেন। কানন বালার ভজনগুলোও তার জীবনের ধর্ম হয়ে গেলে ছোটবেলা থেকেই।
যখন তার বন্ধু, সহপাঠী ও শিক্ষকরা একটি গানের অনুষ্ঠানে তার পরিপাটি উপস্থাপনে চমকে গেলেন, তখন তার মূল (মাতৃ) শিক্ষায়তন লাহোরের ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টসে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক আসরার আহমাদ তাকে একটি প্রতিশ্রুতিশীল ও ক্রমবর্ধমান প্রতিভা হিসেবে চিহ্নিত করলেন।
এরপর দ্রুতই তাদের সাহায্যে নূরের জীবনটি গানের দিকে চিরকালের জন্য চলে যেতে থাকলো।
দ্রুতই তিনি রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠানগুলোতে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে গেয়ে চলেছেন-নিজেকে আবিস্কার করলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধের সময়ে নাইয়ারা নূরে অভিষেক ঘটেছে পাকিস্তান টেলিভিশনের গানের আসরগুলোতে।
এরপর নির্বিঘ্নেই এই প্রখ্যাত গায়িকা পাকিস্তানের সিনেমাগুলোতে গান করা শুরু করলেন। তার মেলোডি, কন্ঠের জাদু চিরকালের জন্য গাঁথা আছে ‘ঘরানা’, ‘তানসেন’র মতো বিখ্যাত ছবিতে। তিনি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সিনেমা পুরস্কার ‘নিগার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন ‘ঘরানা’র জন্য। ছবিটি ১৯৭৩ সালে বেরিয়েছে। তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে থাকবেন তার গজলগুলোর জন্য।
তিনি মাহফিলগুলোতে পরিবেশন করেছেন। পাকিস্তান ও ভারতের সত্যিকারের গজলপ্রেমীদের অনুরোধে গাইতে গিয়েছেন তিনি ও তাদের সঙ্গ দারুণভাবে উপভোগ করেছেন, মাতিয়ে দিয়েছেন সবখানে।
তার অত্যন্ত বিখ্যাত বা সুপারডুপার হিট গজল হলো ‘এ জাজবার-এ-দিল-ঘার মেইন চাহু’। গীতটি লিখেছেন একজন বিখ্যাত উর্দু কবি বেহজাদ লখনোইভি। তিনি পাকিস্তান রেডিওর একজন বিখ্যাত গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার ছিলেন।
এ ছাড়াও তিনি গলায় পরিবেশন করেছেন চিরকালের জন্য বিশ্বখ্যাত কবি গালিব, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের গজল। পারফর্ম করেছেন মেহেদী হাসানের সঙ্গে।
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের একটি দুর্লভ হিন্দি ভাষায় লেখা কবিতা হলো ‘বারখা বাসে চাট পের’। গানটি তিনি পেশ করেছেন তার স্বামী শাহরিয়ার জাহিদীর সঙ্গে ১৯৭৬ সালে। গানটি তারা পরিবেশন করেছেন নূরের জন্ম দিনে। এই গানটি তার জীবনে নিজে করা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্ম হিসেবে গণিত।
নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সময়েই নাইয়ারা নূর বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শাহরিয়ার জায়িদীকে। এরপর থেকে তিনি ধীরে, ধীরে লাইভ পারফরমেন্সগুলোর বিষয়ে খুঁত, খুঁতে হয়ে যেতে থাকলেন।
তিনি বলেছেন ডনকে একবার, ‘গান আমার জীবনে প্রবল অনুরাগ হিসেবে থেকেছে সবসময় কিন্তু আমার সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হয়নি। আমি একজন ছাত্রী ছিলাম, পড়ালেখা করেছি, এরও আগে একজন কন্যা। এরপর আমি একজন গায়িকা হয়েছি। এই ধারাবাহিক জীবনে আমি বিয়ে করেছি। তারপর আমার প্রাথমিক দায়িত্বগুলো ছিল একজন স্ত্রী ও মায়ের জীবন।’
২০০৬ সালে এই গায়িকা নাইয়ারা নূরকে ‘বুলবুল-ই-পাকিস্তান’ খেতাবে সরকার ভূষিত করেছেন। সেই বছরেই তিনি ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স অ্যাওয়াড’ লাভ করেছেন। দিয়েছেন দুটোই পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। ২০১২ সালে তিনি তার পেশাগত গানের জীবনকে বিদায় জানিয়েছেন।
দেশের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ নাইয়ারা নূরের চলে যাওয়ায় গভীর দু:খ প্রকাশ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘গানের দুনিয়ার একটি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।’
তিনি টুইটারে আরো লিখেছেন, ‘একটি গজল বা গানই হোক, নাইয়ারা নূর যাই গান, তিনি পরিপূর্ণভাবে গান করেন। তিনি চলে যাওয়ায় যে শূণ্যস্থান তৈরি হলো, কোনোদিনও পূরণ হবে না।’
নাইয়ারা নূর ও শাহরিয়ার জায়িদীর দুই ছেলে। বড় ছেলে নাদ-ই-অলী একজন একক গানের শিল্পী আর ছোট ছেলে জাফের জায়িদী কাভিশ মিউজিক ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট।
তাদের মা দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গীত, নাজম (গজল ও নাজম উর্দু কবিতা এবং গান লেখার দুটি প্রধান ধারা) ও দেশের গান গেয়েছেন।
ওএফএস/