মহানায়িকার জন্মদিন আজ
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্মদিন আজ (৬ এপ্রিল)। বেঁচে থাকলে ৯১ বছরে পা রাখতেন তিনি।
পাবনা জেলায় ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রমা দাশগুপ্ত ওরফে সুচিত্রা সেন। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সুচিত্রা সেন ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা।
১৯৪৭ সালে দিবানাথ সেনকে বিয়ের সূত্রে কলকাতায় পাড়ি জমান পাবনার রমা। বিয়ের পরে ১৯৫২ সালে ‘শেষ কথায়’ সিনেমার মাধ্যমে রূপালি পর্দায় নায়িকার ভূমিকায় প্রথম আত্মপ্রকাশ তার। পাবনার রমার নাম বদলে হয় সুচিত্রা।
১৯৫১ সালে পরিচালক সুকুমার রায় যখন এ নায়িকাকে আবিষ্কার করলেন তখন তার নাম ছিল রমা সেন। এ বিষয়ে পরিচালক সুকুমার রায় একবার বলেছিলেন, ‘১৯৫১ সালে সাত নম্বর কয়েদী’ ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছি। এমন সময় অসিত চৌধুরী আমাকে বললেন, একটি ভালো শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে আছে। মনে হয় সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে খুব নাম করবে। তার কথায় মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিতে বললাম। প্রথম দিন ওর স্বামী দিবানাথ সেনের সঙ্গে এসেছিল দেখা করতে অরোরা স্টুডিওতে। দেখলাম, ছিপছিপে চেহারায় ডাগর ধরনের চোখ। চোখ দুটি বড় সুন্দর আর খুব এক্সপ্রেসিভ। চাহনিতে স্বচ্ছ গভীরতা। মিষ্টি হাসিতে সারা মুখখানা যেন উচ্ছলতায় ভরে যায়। এক নজরেই পছন্দ হয়ে গেল। কণ্ঠস্বরও বেশ মিষ্টি। কথার মধ্যে একটু বাঙাল টোন আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নিতে রাজি হয়ে গেলাম।’
‘সাত নম্বর কয়েদী’ সিনেমায় অভিনয়ের পর সুচিত্রা সেন পিনাকী মুখার্জি পরিচালিত ‘সংকেত’ সিনেমায় অভিনয় করেন। তখনো তিনি ‘সুচিত্রা সেন’ নামে পরিচিত হননি। এরপর নীরেন লাহিড়ীর ‘কাজরী’ সিনেমার মাধ্যমে ১৯৫২ সালে রমা সেন বদলে ‘সুচিত্রা সেন’ নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
সুচিত্রা সেনের ডাগর নয়নের চাহনি, হাসি ও অভিনয় প্রতিভায় মগ্ন হয়েছিলেন সব শ্রেণি-পেশার দর্শক। এ সময় তৈরি হয় অবিস্মরণীয় উত্তম-সুচিত্রা জুটি। মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে উপহার দিয়েছিলেন একের পর এক অসাধারণ সব সিনেমা।
উত্তম কুমার ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার, বসন্ত চ্যাটার্জিসহ অনেকের সঙ্গেই জুটি বেঁধে কাজ করেছেন এ মহনায়িকা।
‘শাপ মোচন’, ‘হারানো সুর’, ‘পথে হল দেরি’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সপ্তপদী’, ‘গৃহদাহ’, ‘হার মানা হার’, ‘হসপিটাল’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘সাগরিকা’, ‘দত্তা’ প্রভৃতি সিনেমায় সুচিত্রা সেন তার অসাধারণ প্রতিভার সাক্ষর রেখেছিলেন, যা আজও দর্শক হৃদয়ে দাগ কেটে আছে।
বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে হিন্দি সিনেমার জগতেও সুচিত্রা সেন বেশ কিছু কাজ করেছিলেন। ১৯৫৫ তে ‘দেবদাস’ সিনেমায় দিলীপ কুমারের বিপরীতে পার্বতীর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এতে সুচিত্রা সেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেন। এরপর ‘মমতা’ ও ‘আঁধি’ সিনেমার জন্য ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারের মাধ্যমে সুচিত্রা তার অভিনয় প্রতিভার জানান দিয়েছিলেন বলিউডে।
সুচিত্রাই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে ১৯৬৩-তে ‘সপ্তপদী’র জন্য পান মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকেও সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমা মুক্তি পেয়েছে।
সুচিত্রা সেন অভিনীত শেষ সিনেমা ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। ওই বছরই তিনি সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে চিরতরে অবসর নেন। এরপর তিনি লোকচক্ষু থেকে আত্মগোপন করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন। ১৯৯৩ সালের প্রথম দিকে অসুস্থ হয়ে কিংবদন্তি আরেক নায়িকা কানন দেবী যখন হাসপাতালে, তাকে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। এরপর একদম অন্তরালে চলে যান এ মহানায়িকা।
২০০৫ সালে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার নিতেও যাননি তিনি। ২০১২ সালে বঙ্গ বিভূষণ পুরস্কার পান। তার হয়ে কন্যা মুনমুন সেন এ পুরস্কার গ্রহণ করেন।
সুচিত্রা ছিলেন এক কন্যার জননী। সেই কন্যা মুনমুনও একজন গুণী অভিনেত্রী। সুচিত্রার দুই নাতনী রিয়া ও রাইমা সেনও জনপ্রিয় অভিনেত্রী। মহানায়িকা সুচিত্রা সেন ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
এএম/এসএন