উদ্যানজাত ফসলের ক্ষুদ্র আকারের প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে সেমিনার
ফল ও সবজির সংগ্রহ পরবর্তী অপচয় বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা
জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প-২ এর অর্থায়নে ‘গ্রামীণ আয় সৃষ্টির জন্য উদ্যানজাত ফসলের ক্ষুদ্র আকারের প্রক্রিয়াকরণ’ শীর্ষক জাতীয় কর্মশালা ঢাকার হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (৩০ মার্চ) দিনব্যাপী এ কর্মশালায় সারাদেশের শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ, কৃষি-উৎপাদনকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান, সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, গবেষক, স্টেকহোল্ডারসহ প্রায় ১০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন।
কর্মশালায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশে ফল ও সবজির বর্তমান ক্ষতির অবস্থা, আর্থিক মূল্য এবং পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ও উপাত্ত তুলে ধরেন।
ড. চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর ফল ও সবজির সংগ্রহ পরবর্তী অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা এবং এই ক্ষতি ২০-৪৫% হয়ে থাকে। ফসলের এই ক্ষতি মূলত: পরিমাণগত এবং গুণগত হিসাবে হয়ে থাকে। ফসলের এই ব্যাপক ক্ষতি কমিয়ে কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ সময় বাড়াতে উন্নত ও উপযোগী প্রযুক্তি প্রয়োগ অপরিহার্য।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য মাত্র ১% প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়। উদ্যানজাতীয় ফসলের প্রক্রিয়াজাতকরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিপণ্য খুবই পচনশীল কাজেই উপযুক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মোড়কজাত করা, ফ্রেশকাট হিসেবে বিপণনের ব্যবস্থা এবং খাদ্যদ্রব্য তৈরির মাধ্যমে মূল্য সংযোজন সময়ের দাবি। এতে সময়ের সাশ্রয় হবে এবং অতি সহজেই প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রান্না করা যাবে।
তিনি আম, কলা, কাঁঠাল ও আনারসসহ বিভিন্ন সতেজ সবজি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। কুটির শিল্পকে অর্থ, যন্ত্রপাতি, মোড়কজাত দ্রব্য, কাঁচামাল সহজলভ্য করতে অনুরোধ জানান। এতে বেকার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এবং কৃষিপণ্য বাণিজ্যিকীকরণে দ্রুত সম্প্রসারণ সম্ভব হবে; যা বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নেয়া বিভিন্ন পরিকল্পনার সাথে সম্পর্কিত। তিনি উল্লেখ করেন বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করা, অর্থ সহায়তা, সহজেই প্রডাক্ট লাইসেন্সিং এর ব্যবস্থা নেয়া এবং বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাগণ বিশেষ করে কুটির শিল্প উদ্যোক্তাদের সরাসরি সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহাতাব উদ্দিন অবহিত করেন যে, কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা বৃহৎ শিল্পের দ্বারা তৈরি পণ্য প্রস্তুত করার জন্য সেকেন্ডারি প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারেন।
অনুষ্ঠানে জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প-২ এর কৃষি সম্প্রসারণ অংশের পরিচালক আজহারুল ইসলাম সিদ্দিক উল্লেখ করেন, যে ফল ও শাকসবজির মূল্য সংযোজন আমাদের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য এবং কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত স্টেকহোল্ডারদের জন্য খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের উপর দেশব্যাপী প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করছে।
এসিআই মোটরস্ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এফ এইচ আনসারী বলেন, কৃষি পণ্য তৈরির জন্য কাঁচামাল অপরিহার্য এবং আমরা বিদেশ থেকে অনেক কাঁচামাল প্রতিবছরই আমদানি করি এবং এ খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু আমরা কুটির শিল্পের উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে কাঁচামাল প্রস্তুত করতে পারি এবং তারা বৃহৎ শিল্পে সরবরাহ করতে পারে যা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। এটা অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হবে নিঃসন্দেহে।
জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প-২ এর প্রকল্প পরিচালক মো. মতিউর রহমান বলেন, অর্থ সাশ্রয়ের জন্য ফসলের ক্ষতি হ্রাস করা আমাদের দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা প্রয়োজন সেক্ষেত্রে দেশের অনেক বেকার যুবক প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন ফল ও সবজিতে সহজেই মূল্য সংযোজনের সুযোগ রয়েছে। প্রকল্পটি স্টেকহোল্ডারদের জন্য প্রযুক্তি এবং যথাযথ পরিবেশবান্ধব মেশিন উদ্ভাবনকে বিকশিত করতে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. দেবাশিষ সরকার উল্লেখ করেন পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ স্টেকহোল্ডারদের জন্য মূল্য সংযোজন ও আয় বৃদ্ধির জন্য ২৭ ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। যা ইতিমধ্যে অনেকেই ব্যবহার করছে এবং ব্যবহারের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই বিভাগটি বিভিন্ন প্রচারমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন এবং পণ্য বিপণনের জন্য উপযুক্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য সচেতনতা সৃষ্টিসহ নানাবিধ কার্যক্রম সারাদেশে পরিচালনা করছে।
ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রাক্তন উপাচার্য ড. এম এ সাত্তার মণ্ডল বলেন, ফসল সংগ্রহের পর ক্ষতি কমাতে সারা বিশ্বে চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মূল্য সংযোজনের জন্য কৃষিপণ্যের বহুমুখী ব্যবহার বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের অর্থ সহায়তা প্রদান, যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণন বিষয়ে প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি; যাতে তারা সঠিক সময়ে পণ্য বাজারজাত করতে সক্ষম হয়। তিনি প্রতিটি কৃষি প্রযুক্তির অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
সচেতনতা বাড়াতে তথ্য প্রচার করতে হবে যাতে তারা ব্যয় সুবিধা উপলব্ধি করতে পারে যা কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে জড়িত হওয়ার জন্য উৎসাহ ও আস্থা বাড়াতে এবং শেষ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বাজারে টিকে থাকতে সহায়তা করবে। মান বজায় রাখার জন্য আর্ন্তজাতিক বাজারেও সহায়তা করতে পারবে।
কর্মশালার সভাপতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাক্তন মহাপরিচালক ও হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মঞ্জুরুল হান্নান বলেন, এই কর্মশালাটি কুটির শিল্পসহ যেকোনো উদ্যোক্তাকে বাছাই এবং গ্রহণে কৃষিকে সহায়তা করবে। প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি পরিবারের আয় বাড়াবে এবং স্টেকহোল্ডারদের দ্বারা সেই প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে প্রতি বছর একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস করবে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের উপ-সহকারী পরিচালক মিতুল কুমার সাহা।
এপি/