ব্যাংকপাড়ায় ভুয়া ঋণের ফাঁদ
দেখতে লাখ টাকার বান্ডিল, আসলে সবই ভুয়া
চলাফেরায় আভিজাত্যের ছাপ। হটাৎ দেখে কেউ ব্যাংকের কর্মকর্তাও মনে করতে পারেন। রবি থেকে বৃহস্পতিবার মতিঝিল এলাকায় সরব উপস্থিতি। কখনো বড় হোটেলে আবার কখনো ফুটপাতে। সব জায়গায় সরব উপস্থিতি। আসলে তারা কারা? তারা কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তা বা কোনো স্থানে চাকরিও করে না। তারা ঋণ দেওয়ার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে। শুধু কি প্রতারণা, ঋণগ্রহীতাকে নকল টাকা দিয়ে এমন কারসাজির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, তারা যেন কাউকে এ বিষয়ে না বলতে পারে।
এ রকম একটি সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। প্রতারণার অভিনব সব পন্থা শুনে গোয়েন্দারাও চমকে উঠেছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণগ্রহীতাদের এমনভাবেই তারা ফাঁদে ফেলে সেখান থেকে বের হতে পারে না। ঋণ গৃহীতাদের একভাবে আর্থিক ক্ষতির সন্মুখিন করে ফেলে। অন্যদিকে জাল টাকা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয় দেখায়। যার কারণে ভুক্তভোগীরা বড় আর্থিক ক্ষতি হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হতে চায় না।
যেভাবে প্রতারণা করেন তারা
ব্যাংকপাড়া বলা হয় রাজধানীর মতিঝিল এলাকাকে। এখানেই বেশিরভাগ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা চলাফেরা করেন। অনেকে আর্থিক সংকটের কারণে ঋণ নিতে এসব এলাকায় বেশি যাতায়াত করেন। অনেক সময় সঠিক কাগজপত্র দিয়ে ঋণ পেতে অনেকের দেরি হয়। বেশি দেরি হওয়ায় অনেকে বিরক্ত হয়ে ওই ঋণের দিকে আর এগোতে চান না। এরপর অবৈধ পথে এবং অল্প নিয়মনীতিতে ঋণ পেতে অনেকে বিভিন্ন চেষ্টা চালান। অল্প সময়ে ঋণ পাওয়া ও অতিরিক্ত টাকা ঋণের আশায় প্রতারণার খপ্পরে পড়ছেন অনেকেই।
মতিঝিলের ব্যাংকপাড়ায় ঘুরে বেড়ান তারা। টার্গেট একমাত্র ঋণগ্রহীতা। তারা প্রতিশ্রুতি দেন অল্প সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ পাইয়ে দেবেন বলে। সে অনুযায়ী পেপারস নিজেরাই তৈরি করে দেওয়াসহ প্রাথমিকভাবে খরচের টাকা নেন। এরপর পেপারস তৈরি হলে সেই সময় আরেকটি টাকা নেয় ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে। শেষ সময় হিসেবে ঋণের একটি তারিখ দিয়ে সে অনুপাতে কমিশনের পরিপূর্ণ টাকা নিয়ে নেন। প্রতারকরা ঋণগৃহীতাকে চেক নয়, ক্যাশ টাকা দেওয়ার কথা বলেন। ঋণ প্রদানের দিন টাকা নিয়ে তারা আবার নিজেরাই দেখা করেন গ্রাহকের সঙ্গে। ধরিয়ে দেন লাখ লাখ টাকার বান্ডিল। তবে বান্ডিল খোলার পর তাতে মেলে শুধু কাগজ। অভিনব এ প্রতারকচক্রের দুই সদস্যকে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
যা বলছে গোয়েন্দা পুলিশ
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দেখতে লাখ টাকার বান্ডিল মনে হলেও তাতে কোনো টাকাই নেই। পুরোটাই কাগজের। ওপরে এবং নিচে এক হাজার টাকার নোট। তাও আবার জাল। এক শ্রেণির প্রতারক অভিনব কায়দায় কাগজকে টাকা বলে চালিয়ে দিচ্ছে। তারা বলছেন, খালি চোখে দেখলে ১ হাজার টাকা নোটের বান্ডিলই মনে হবে। তবে ধারণা কেটে যাবে হাতে নিয়ে দেখলেই। ভেতরে কোনো টাকা নেই। টাকার মাপে কাগজ কেটে তৈরি করা হয়েছে বান্ডিলগুলো।
একটি দুটি নয়, ৩২টি বান্ডিল যেগুলো দৈর্ঘ্য প্রস্থে এক হাজার টাকা নোটের সমান। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগ রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে এই বান্ডিলগুলো। গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুজনকে।
তবে এই চক্রের মাস্টারমাইন্ডসহ আরও কয়েকজনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা যার কারণে তারা সংবাদমাধ্যমে এসব চক্রের নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক রয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরও বলছেন, এ প্রতারকেরা মতিঝিলের ব্যাংকপাড়ায় ঘুরতে থাকে। বেশ কয়েকজন আছে এই চক্রের সদস্য। কমিশনের বিনিমেয়ে বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও ও সমিতি থেকে ঋণ পাওয়ার নিশ্চয়তা দেন তারা। কাগজপত্র এবং অগ্রিম কমিশনের টাকা নেওয়ার পর ঋণগ্রহীতাকে জানানো হয় ঋণের অনুমোদন পাওয়া গেছে। নির্দিষ্ট দিনে লোনের টাকা নিয়ে তারা নিজেই হাজির হন। কাগজের এসব বান্ডিল বিশেষ প্যাকেটে মুড়িয়ে ধরিয়ে দেন ঋণগ্রহীতাকে। বাড়িতে গিয়ে প্যাকেট খোলার পরামর্শ দেন।
টাকা দ্বিগুণ করার ব্যবসাও করে চক্রটি
এদিকে পুলিশ বলছে, টাকা দ্বিগুণ করার ব্যবসাও করে চক্রটি। মূলত লোভ থেকেই মানুষ তাদের ফাদেঁ পা দেন। ভুক্তভোগী কয়েকজনের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, তারা লোনের জন্য মতিঝিল এলাকায় যাতায়াত করতেন। আর এ সময়ে পরিচয় ঘটে এ চক্রের সদস্যদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কথা বলার প্রথম পর্যায়ে ভালোই মনে হয়েছিল। এরপর দেড়কোটি টাকা ঋণের প্রস্তাব করলে তারা রাজিও হয়। পরে কিছু ডকুমেন্ট তারা নেয়। এরপর তিন ধাপে ২২ লাখ টাকা নেয়। পরে লোনের প্রথম অংশ ৭৫ লাখ টাকা আছে বলে এটি ব্যাগ ধরিয়ে দেয়।
যা বলছেন ভুক্তভোগীরা
যেহেতু টাকার ব্যাগ। ভেতর থেকে একটা বান্ডিল দেখিয়ে তারা জানায়। রাস্তায় না খুলে বাসায় গিয়ে খুলতে। বাসায় নিয়ে আসার পর দেখা যায়, আসলে ব্যাগে কোনো টাকাই নেই। উপরে ১ হাজার টাকার একটি জাল নোট আর নিচের অংশে অপর একটি ১ হাজার টাকার জাল নোট। আর মাঝখানে সবগুলো কাগজ দিয়ে ভরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এমন অবস্থায় নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। মানুষ এমনভাবেও প্রতারণা করতে পারে কল্পনা করা যায়নি।
বাবলু নামের এক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, তিনি এক কোটি টাকার লোনের জন্য তাদের মোট ৮ লাখ টাকা দিয়েছেন। তিনিও একইভাবে প্রতারণার শিকার হন।
তিনি আরও জানান, প্রতারিত হওয়ার পর তিনি শুনেছেন, মতিঝিল এলাকায় এলে এমন অনেক প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের প্রতারকদের কঠোর শাস্তিও দাবি করেন তিনি।
ব্যাংক কর্মকর্তার বক্তব্য
ব্যাংকের নাম বলতে অনিচ্ছুক ব্যাংক কর্মকর্তা নাজমুল আলম রানা জানান, দুই শ্রেণির ঋণগৃহীতা রয়েছে। যারা রানিং ব্যবসা করেন, তারা কিন্তু সঠিক নিয়ম মেনেই ব্যাংক ঋণের আবেদন করেন। তাদের প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আরেক শ্রেণির ঋণগৃহীতা রয়েছে, যাদের পেপারসও ঠিকঠাক থাকে না, আবার ঋণ পরিশোধেরও চিন্তা থাকে না। অর্থাৎ ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ঋণ নিতে চায়। মূলত তারাই প্রতারিত হয়েছে বা হচ্ছে।
নাজমুল আলম আরও জানান, ব্যাংকের কাজই ঋণ দেওয়া। আর গ্রাহক তা নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করবেন। সুতরাং প্রকৃত ঋণগ্রাহক সরাসরি ব্যাংকে এলে কোনো ধরনের প্রতারণার সম্ভাবনা থাকে না। ব্যাংকে এলে তিনি ঋণগ্রহণের উপযুক্ত হলে ব্যাংক তাকে ফেরায় না।
চলছে অভিযান
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (রমনা) বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক জানিয়েছেন, এ প্রতারক চক্রটি প্রথমে চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে কে ঋণ নিতে চায় এমন ব্যক্তি খুঁজে বের করে। পরে কী ধরনের ঋণ নিতে চায় সে বিষয়টি আগে তারা বোঝার চেষ্টা করে, তারপর তারা কৌশলে প্রতারণা করার পরিকল্পনা করে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এরা মূলত প্রতারক। এ চক্রটি প্রথমে সবার সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে। পরে কীভাবে লোন ব্যাংক থেকে পাওয়া যাবে তার ব্যবস্থা করার কথা বলে। মানুষ ও লোভে পড়ে একারণে তারা ও প্রতারণা হয়।
ডিবি পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, যে সব মানুষ যারা এভাবে লোন নিতে চায়, তারা মনে করেন কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই লোন পাওয়া যাচ্ছে এটাই ভালো পথ। এই সুযোগে এ প্রতারক চক্র লোন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে নানান সময় টাকা নেয় তাদের কাছ থেকে। যখন টাকা দেওয়ার সময় আসে তখন তারা জনসমাগম আছে এমন জায়গা বেছে নেয়, তারপর এ জাল নোটের বান্ডিলগুলো তাদের হাতে তুলে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন
বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা ঋণ নিতে চান তারা মূলত সেটি অল্প সময়ের মধ্যে পেতে চান। দেরি হওয়ায় তারা মনে করেন ব্যাংকের জটিলতা। এ কারণে তারা প্রতারকের সহযোগিতা নিতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। এজন্য অনেকে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। তবে সামান্য একটু সতর্ক ও লোভ-লালসা রোধ করতে পারলে এসব প্রতারণা থেকে তারা বাঁচতে পারেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ‘সম্প্রতি অনেক মানুষ ঋণের খপ্পরে পড়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। বৈধ পথে লোন নেওয়ার কার্যক্রম চলমান রাখলে তারা এমন প্রতারণার শিকার হতো না। অতিরিক্ত লোভ লালসার কারণে সাধারণ মানুষ এসব প্রতারকের খপ্পরে পড়েছে এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঋণ দেওয়ার নামে যারা মানুষের সর্বস্ব লুট করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত এবং এ চক্র বা প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা দূরত্ব আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হয়তো এমন অপরাধ কমে আসবে। প্রতারকরা ভয়ে থাকবে, এ থেকে মানুষও মুক্তি পাবে।’
কেএম/এসএ/