টুরিস্ট ভিসা: রঙিন স্বপ্নে ভয়ংকর যাত্রা
টুরিস্ট ভিসার মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে ভয়ংকর ফাঁদে পড়ছেন অনেকেই। রঙিন স্বপ্নের আশায় ভয়ঙ্কর হচ্ছে এ যাত্রা।
মাদারীপুরের টেকেরহাটের স্থানীয় এক কলেজের সম্মান শেষ বর্ষের ছাত্র রাকিবুল ইসলাম। গ্রামের আশপাশের লোকজনের ইউরোপ যাওয়া দেখে রাকিবুলও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ইউরোপ যাওয়ার। এক দালালের ১১ লাখ টাকার চুক্তিতে ইতালি যাওয়ার ব্যবস্থা হয়। প্রথমে দুবাই, এরপর লিবিয়া। আর লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি। ঝুঁকি থাকলেও ইউরোপের স্বপ্নে বিভোর রাকিবুলও রাজি হয়ে যায়।
এরপর ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে দুবাই চলেও যান রাকিবুল। সেখান থেকে লিবিয়া। এক পর্যায়ে বুঝতে পারেন দালালের প্রতারণায় পাচার হয়েছেন তিনি। দালালদের খপ্পরে পড়ে শুরু হয় দুর্বিসহ জীবন। কখনো জঙ্গল, কখনো মরুভূমি বা অন্ধকার কক্ষে দিন কাটতে থাকে তার। রাকিবুলকে বাঁচাতে পরিবার ওই ১১ লাখের পরে আরও ৪ লাখ টাকা দেয়। পরে লিবিয়া পুলিশের সহায়তা আটক হয়ে জেলখানায়।
বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) লিবিয়ার বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা ও লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় ১১৪ জন দেশে ফেরেন। সকাল সোয়া ৮টায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরে অবতরণ করে বোরাক এয়ারের ফ্লাইট। রাকিবুলের আপন চাচা আব্দুল আওয়াল বিমানবন্দরের বাইরে শোনান রাকিবুলের লিবিয়া যাত্রা গল্প।
একই এলাকার রাসেল। একইভাবে ফাঁদে পড়েন তিনিও। টুরিস্ট ভিসায় দুবাই এরপর লিবিয়া। আর সেখানেই আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের হাতে পড়ে মুক্তিপণ দেন। পরে লিবিয়া পুলিশের হাতে পড়ে জেলে গিয়ে একই দলের সঙ্গে ফেরেন। বিমানবন্দরে দেখা করতে আসা নিকট আত্নীয় জানান, মোট ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। লিবিয়া যাওয়ার পরও দালালরা ধাপে ধাপে টাকা নিয়েছেন। জীবিত থাকবে এমন আশাতেই টাকা দিয়েছি আমরা।
আরেক ভুক্তভোগী সাগর মণ্ডলের আত্নীয় বিশ্ব মণ্ডল বলেন, ‘টুরিস্ট ভিসার আড়ালে যা হচ্ছে পরিষ্কার তা মানবপাচার। আর এ মানবপাচারে স্থানীয় দালাল, কতিপয় ট্রাভেল এজেন্সি ও ইমিগ্রেশন পুলিশও জড়িত।’
তিনি বলেন, যিনি কোনো দিন দেশের বাইরেই যাননি তিনি দুবাই যাচ্ছেন। দুবাই কার কাছে যাবে, কতদিন থাকবে, হোটেল বুকিং আছে কি না, রিটার্ন টিকিট নিয়েছে কি না। সব তদারকির দ্বায়িত্ব ইমিগ্রেশন পুলিশের। সন্দেহ হলেই তারা অফলোড করে দেবে। কিন্তু তারা সেটি না করে তাদের বের করে দিচ্ছে। এ অবস্থাতে ইমিগ্রেশন পুলিশ কোনোভাবেই তাদের দ্বায় এড়াতে পারে না।
এদিকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক পলাশ বলেন, ২০২১ সালের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই, ওমান, মালয়েশিয়া যান তারা। সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় গেলে দালালরা ত্রিপোলিতে নিয়ে তাদের গেম ঘরে রাখে। পরে বিভিন্ন সময় লিবিয়ার পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করে। তারা দালালদের ১১ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে দিয়েছিলেন অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশ যাওয়ার জন্য। ধরা পড়ার পর যাত্রীদের সবাই জেল খেটেছেন। পরে আইওএম আউট পাস নিয়ে তাদের উদ্ধার করে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। সবাইকে খাবার ও ৪ হাজার ৭৫০ টাকা অর্থ সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ফেরত আসা সবাইকে সিআইডি দীর্ঘসময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পরে তিন দিনের কোয়ারেন্টিনে হজ ক্যাম্পে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি ডোমেনিকান প্রজাতন্ত্র থেকেও ৩০ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ইউরোপ যাওয়ার এ প্রবণতা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে মন্তব্য করে পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার (এআইজি) আলমগীর হোসেন শিমুল বলেন, এক শ্রেণির দালাল ও ট্রাভেল এজেন্সির প্রতারণার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। তারা ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে তরুণদের প্রভাবিত করে। সেই ফাঁদে পা দিয়ে কেউ কেউ মৃত্যুর মুখেও পতিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখানে ইমিগ্রেশন পুলিশকও অনেক সময় দ্বায়ী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ইমিগ্রেশন পুলিশ যদি যেতে না দেয় তাহলে অভিযোগ করে, আবার যেতে দিলে বলে টাকা খায়। এ অবস্থায় তারাও দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে থাকে। এটি নিয়ে একদিকে সরকারকে কাজ করতে হবে অন্যদিকে এর কুফল নিয়ে গণমাধ্যমে বার বার সংবাদ প্রকাশ হলে জনগণের মধ্যে সচেতনতা আসবে।
এদিকে দুবাইয়ে গত কয়েক বছর থেকে ট্যুরিস্ট ভিসায় লোক নিয়ে যাচ্ছিলেন টাঙ্গাইলের নাঈম খান ওরফে লোটাস। এভাবে নাঈম ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে দুবাইয়ে পাচার করেছেন। সম্প্রতি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নকল করে আরও কিছু ব্যক্তিকে দুবাই পাঠানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কার্ড নকল করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে এ নকল কার্ড উদ্ধারের পর আসল ঘটনা বেরিয়ে আসতে শুরু করে।
পরে র্যাব ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, বিএমইটির কার্ড নকল করে ভ্রমণ ভিসায় লোক পাঠানো হচ্ছে। এরপর শুরু হয় অভিযান। রাজধানীর তুরাগ, উত্তরা, রমনা, পল্টন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মানবপাচার চক্রের মূল হোতা নাইম খান ওরফে লোটাসসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।
র্যাব-৩-এর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, চক্রটির দুবাইয়ে কর্মী পাঠানো বন্ধ থাকলেও উচ্চ বেতনের লোভ দেখিয়ে জনপ্রতি আড়াই থেকে ৩ লাখ করে টাকা নিয়ে নকল কার্ড দিয়ে অনেককে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই পাঠানোর চেষ্টা চলছিল। ইতোমধ্যে শতাধিক ব্যক্তিকে পাঠানোর আয়োজনও সম্পন্ন করেছিল চক্রটি। কিন্তু আমাদের নজরে আসায় তা বন্ধ হয়ে গেছে।
চক্রটি গত কয়েক বছরে সাড়ে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে টুরিস্ট ভিসায় দুবাই পাচার করেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সেখানে গিয়ে বেকার ও মানবেতর জীবনযাপন করে পরে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে।
তিনি বলেন, চক্রটির মূল হোতা লোটাস। লোটাস ২০১২ সালে দুবাই যান। সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি মিললে তিনি টুরিস্ট ভিসায় বিভিন্ন জনকে নিয়ে যেতে থাকেন। সম্প্রতি ওয়ার্ক পারমিট কার্ড লাগে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে লোটাস তার সদস্যদের দিয়ে ভুয়া বিএমইটির কার্ড বানিয়ে অনেককে পাচার করেছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে লোটাস র্যাবকে জানান, দুবাইয়ে ফারুক ও বাংলাদেশে নূরে আলম শাহরিয়ার তার অন্যতম সহযোগী। শাহরিয়ার মূলত প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র তৈরি করতেন। শাহরিয়ার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় বসে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। অন্যদিকে মহসিন নামে একজনের কাছ থেকে খালি কার্ড কিনে আনে। প্রকৃত বিএমইটি কার্ড স্ক্যান করে তিনি নিজেই গ্রাফিক্স করেন। তারপর ভুক্তভোগীর পাসপোর্টে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কার্ডের পেছনে তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় এবং বদরুলের নির্দেশ মতো রিক্রুটিং লাইসেন্সের নম্বর বসিয়ে দেওয়া হতো। এভাবে দুবাই পাচার করা হতো শত শত ব্যক্তিকে।
ইমিগ্রেশন বিভাগের ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, টুরিস্ট ভিসায় দেশের বাইরে যাওয়ার পর ফিরে না এসে সেখানে অবৈধভাবে থেকে যাওয়া খুবই দুঃখজনক। এক শ্রেণির ট্রাভেল এজেন্সির কারসাজিতে পড়ে একদিকে যেমন নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ পরিবার অন্যদিকে বিদেশে এভাবে গিয়ে তারা জেল হাজতে থাকছেন। দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ করছে। অনেক সময় তারা মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়েছেন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া ও অবৈধভাবে দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশি ফেরত আসার ঘটনায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা বলেন, এটি মানবপাচারের সামিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। টুরিস্ট ভিসার ক্ষেত্রে লোকজন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ কিছু বললেই তারা হয়রানির অভিযোগ করেন। এ অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে ইমিগ্রেশন পুলিশ আরও কঠোর হবে। পাশাপাশি যেসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ আসবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, এ পর্যন্ত র্যাব আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের বিদেশি নাগরিকসহ অসংখ্য মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। রাজধানীসহ বেশ কিছু এলাকায় মানব পাচারকারী চক্রের তথ্য পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চলমান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, মানুষ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য অনেক কিছু করছে। দেশে ভালো কিছু করতে না পেরে তারা টুরিস্ট ভিসার মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু তারা ভাবছে না যে সমুদ্রপথে বা অন্যভাবে বিদেশে গেলে তিনি বিভিন্ন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এসব কথা যদি তারা চিন্তা করতেন তাহলে তারা এমন ঝুঁকি নিতেন না। তবে যারা টুরিস্ট ভিসার ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করছেন বা হেনস্তা করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
কেএম/এসএন