কোভিড টেস্টে নেগেটিভের আশ্বাস, কোটি টাকার প্রতারণা
বিদেশগামী যাত্রীদের করোনাভাইরাস টেস্টে নেগেটিভ ফলাফল দেওয়ার কথা বলে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। এমন অভিযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গ্রেপ্তারের পর র্যাব বলেছে, সারাদেশের ৬ জেলাকে টার্গেট করে তারা অভিনব কায়দায় প্রতারণা করে আসছিল। অবশেষে র্যাবের কাছে ধরা পড়তে হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মো. জসিম উদ্দিন, মো. সুলতান মিয়া, মো. বেলাল হোসেন, মো. আবুল হোসেন, মো. আবদুল নুর, মো. আলফাজ মিয়া, মো. শামিম, মো. আহাম্মদ হোসেন, মো. ইমরান উদ্দিন মিলন, মো. সবুজ মিয়া, মো. আব্দুর রশিদ, আব্দুল করিম চৌধুরী, মো. আঙ্গুর মিয়া, আলমগীর হোসেন। অভিযানে জব্দ করা হয় প্রায় ৭ লক্ষ টাকা, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১২০টি সিমকার্ড, সিম অ্যাক্টিভেট করার ১টি ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন, ১টি ট্যাব, ৩২টি মোবাইল, ১টি পাসপোর্ট, নোটবুক এবং চক্রের সদস্যদের বেতনের হিসাব বিবরণী।
আত্মসাৎকৃত অর্থ ও প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ অবৈধ সিমকার্ডসহ কুমিল্লা, বাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকা থেকে গত বুধবার তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাব জানায়, সরকার নির্ধারিত হাসপাতালে নির্দিষ্ট ফি প্রদানের মাধ্যমে বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা টেস্ট করানোর আদেশ জারি করা হয়। যার প্রেক্ষিতে বিদেশগামী যাত্রীরা সরকার নির্ধারিত হাসপাতালে নির্দিষ্ট ফি প্রদানের মাধ্যমে করোনা টেস্ট করে। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিদেশগামী ব্যক্তিদের টার্গেট করে করোনা টেস্টের ভুয়া পজেটিভ রিপোর্টের কথা বলে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসছে কয়েকটি চক্র।
র্যাব বলছে, বেশকিছু ভুক্তভোগী প্রতারক চক্রকে অর্থ প্রদানের পরেও তাদের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসার প্রেক্ষিতে তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতারণার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে। সাধারণ বিদেশগামী যাত্রী, বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ, সিভিল সার্জন অফিস ও মিডিয়াকর্মী বিভিন্ন সময়ে র্যাবের নিকট এহেন প্রতারণা সংক্রান্ত লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ দায়ের করেন। উক্ত অভিযোগের সত্যতা যাচাই এবং প্রতারকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এ চক্রটি মূলত সারাদেশে কয়েকটি জেলাকে টার্গেট করে প্রতারণা করে আসছে। তাদের কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের মূলহোতা বেলাল জানায়, সে গত মার্চ ২০২১ সালে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য কুমিল্লা জেলার একটি হাসপাতালে করোনা টেস্ট করার পর অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ওই হাসপাতালের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে তার করোনা টেস্টের ফলাফল পজিটিভ এসেছে বলে জানায়। ওই অজ্ঞাত ব্যক্তি ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বেলালের করোনা টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এতে সে চড়া মূল্যের টিকেট নষ্ট না করে ওই অজ্ঞাত ব্যক্তিকে বিশ্বাস করে ১০ হাজার টাকা প্রদান করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মোবাইলে এসএমএস এর মাধ্যমে করোনা পজিটিভ ফলাফল প্রেরণ করে। পরবর্তীকালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওই অজ্ঞাত পরিচয়ধারী কেউ উক্ত হাসপাতালে কর্মরত নেই বলে জানতে পারে এবং সে বুঝতে পারে সে প্রতারিত হয়েছে। পুনরায় এপ্রিল ২০২১ সালে করোনা টেস্ট নেগেটিভ আসার পর বেলাল ওমানের উদ্দেশ্যে গমন করে। তবে মার্চ হতে এপ্রিল ২০২১ এই সময়ে বেলাল প্রতারণার এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে ব্যাপক বিচার বিশ্লেষণ করে এবং প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশগামী যাত্রীদের নিকট হতে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার রুপ রেখা তৈরি করে। তবে তার বিদেশে গমনের নির্ধারিত তারিখ চলে আসায় সে তার এই পরিকল্পনা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সবুজকে অবগত করে। সবুজকে প্রতারণার একটি টিম তৈরি করে দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকা সমানভাগে বণ্টনের প্রতিশ্রুতিতে সে বিদেশ গমন করে। সবুজ প্রতারণার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে তবে বেলালকে যে অর্থ প্রেরণ করা হতো তা নিয়ে বেলালের সবসময় সংশয় থেকে যায়।
তিনি বলেন, এই সংশয় থেকেই মূলত বেলাল ৪ মাস বিদেশে অবস্থান করে ২০২১ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে দেশে চলে আসে। এবার সে তার আরেকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু জসিমকে এই প্রতারণার কাজে সম্পৃক্ত করে। যেহেতু প্রতারণার এই প্রক্রিয়াটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ তাই সে তার মধ্যপ্রাচ্যের ভিসা সচল রাখার জন্য পুনরায় ডিসেম্বর মাসে বিদেশ গমন করে এবং জানুয়ারি মাসে প্রতারণার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য পুনরায় দেশে চলে আসে।
উল্লেখ্য যে, বেলাল, সবুজ ও জসিম ৪-৫ বছর পূর্বে চট্টগ্রামে একইসঙ্গে ভ্রাম্যমাণ কসমেটিক্স এর ব্যবসা করত। সেই সূত্র ধরেই তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তারকৃত আবুল হোসেন নারায়ণগঞ্জ ও বি-বাড়িয়া জেলায়; আব্দুর নূর নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়; আহাম্মেদ হোসেন চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়, আব্দুর রশিদ রাজধানী ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ জেলায়; আব্দুল করিম কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়; আলমগীর সিলেট, মৌলভিবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায়; আঙ্গুর মিয়া কুমিল্লা, মৌলভিবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায় সরকার নির্ধারিত বিদেশগামীদের করোনা টেস্ট হাসপাতালসমূহে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিদেশগামী যাত্রী ছদ্মবেশে অবস্থান করে এবং অত্যন্ত কৌশলে অন্যান্য সাধারণ যাত্রীদের নম্বরগুলো সংগ্রহ করে। নম্বরগুলো সংগ্রহ করে বেলাল ও সবুজকে প্রেরণ করত।
র্যাব জানায়, বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের প্রকৃত করোনা টেস্টের ফলাফল হাতে পাওয়ার পূর্বেই বেলাল ও সবুজ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের করোনা বিভাগের ডাক্তার অথবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগীদের নম্বরে কল দিয়ে করোনা টেস্টের ফলাফল পজিটিভ আসছে বলে মিথ্যা তথ্য প্রদান করত।
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা পজিটিভ রেজাল্ট নেগেটিভ করে দেওয়ার কথা বলে ভুক্তভোগীর নিকট থেকে জন প্রতি মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিত। আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান একই সময়ে বেলাল ও সবুজকে বিভিন্ন জায়গার মোবাইল ব্যাংকিং এর নম্বর প্রদান করত এবং ভুক্তভোগীরা বেলাল ও সবুজ এর কথা অনুযায়ী ঐ সমস্ত নম্বরে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে টাকা প্রেরণ করলে আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান স্ব-শরীরে উপস্থিত থেকে তা সংগ্রহ করত।
তিনি বলেন, এ প্রতারক চক্রটি মূলত একজনের ফিঙ্গার নিয়ে ১০ থেকে ১৫টা সিম নিজেদের আওতায় নিয়ে ভিন্ন কৌশলে প্রতারণা করত। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি এরা অনেকেই ভাসমান ভাবে সিম বিক্রি করত। যদি কেউ সিম কিনতে আসত তাহলে তার কাছ থেকে অতিরিক্ত ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে পরবর্তীকালে ওই সিম দিয়ে কৌশলে প্রতারণা করা হতো।
এ চক্রটি সারাদেশের মোট ৬টি জেলাকে টার্গেট করে প্রায় এক বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিল। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
কেএম/টিটি