রংপুরের মিঠাপুকুরে ইকোপার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল এক দশকেরও বেশি সময় আগে। এটি ছিল উপজেলার একমাত্র বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্প। তবে বাস্তবে এটি পরিণত হয়েছে মাদকসেবী, বখাটে ও অসামাজিক কার্যকলাপকারীদের অভয়ারণ্যে।
২০১৩ সালে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও স্থানীয় সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমান। তখন প্রকল্পের মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১০০ কোটি টাকা। তবে দীর্ঘ এক যুগেও প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। বরং, বরাদ্দ বাড়লেও উন্নয়ন কার্যক্রম তেমন অগ্রগতি লাভ করেনি।
বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকোট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২২৬ একর জায়গায় মিঠাপুকুর ইকোপার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। এতে বিশ্রামাগার, রান্নাঘর, পার্কিং এলাকা, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, গোলঘর, টিকিট কাউন্টার, প্রবেশদ্বার, নিরাপত্তাকক্ষ, গণশৌচাগার, পানির ট্যাংক, পানির সরবরাহ লাইন, পুরাতন বন বিশ্রামাগার উন্নয়ন, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ব্যারাক, পার্ক অফিস ভবন, ডিসপ্লে মানচিত্র, আমব্রেলা শেড, স্পিনার, পাকা বেঞ্চ নির্মাণসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবে, শুধুমাত্র সীমানা প্রাচীর ও কিছু দায়সারা কাজ ছাড়া প্রকল্পটির তেমন কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়নি। এমনকি ইকোপার্কের প্রধান ফটক আজও সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি।
স্থানীয়দের মতে, এই প্রকল্পের শত কোটি টাকার বরাদ্দ কোথায় গেল, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মিঠাপুকুর ইকোপার্কটি রংপুরের শঠিবাড়ী-দিনাজপুরের আফতাবগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। একই মহাসড়কের ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের ব্যক্তিগত বিনোদনকেন্দ্র 'স্বপ্নপুরী' রয়েছে। স্থানীয়রা ধারণা করছেন, স্বপ্নপুরীর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে মিঠাপুকুর ইকোপার্কের উন্নয়ন ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে এবং বরাদ্দকৃত অর্থ লোপাট করা হয়েছে।
সরেজমিনে ইকোপার্ক পরিদর্শন করে দেখা যায়, সেখানে গরু, ছাগল ও ঘোড়া চরছে। প্রবেশদ্বারে কোনো পাহারাদার নেই, চারপাশে সীমানা প্রাচীর থাকলেও একাধিক জায়গায় ভাঙা। এসব পথ দিয়ে বহিরাগত ও মাদকসেবীরা অবাধে প্রবেশ করে সেখানে মাদকের আসর বসায়। দর্শনার্থীরা আসলেও নিরাপত্তার অভাবে দ্রুত ফিরে যান। বিভিন্ন অবকাঠামোর যন্ত্রপাতি অযত্নে নষ্ট হতে বসেছে।
স্থানীয় ১৩ নম্বর গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ তালুকদার বলেন, "ইকোপার্কের প্রকল্পে কত কোটি টাকার কাজ হয়েছে, তার সঠিক তথ্য মন্ত্রণালয়ের নথিতেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইউনিয়ন পরিষদেও কোনো নথি জমা হয়নি। মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিজেল এন্টারপ্রাইজ নিজের ইচ্ছামতো কাজ করেছে।"
এ বিষয়ে বিএনপির মিঠাপুকুর উপজেলা সদস্য সচিব মোঃ মোতাহারুল ইসলাম নিক্সন পাইকাড় বলেন, "আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের প্রতি কোনো জবাবদিহিতা রাখেনি। তাদের নেতাকর্মীরা যেখানে যা পেরেছে লুটপাট করেছে। আমরা যখন বিরোধী দলে ছিলাম, তখনও জানতে পেরেছি যে এখানে ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প চলছে। কিন্তু বাস্তবে কাজের অগ্রগতি নেই বললেই চলে।"
তিনি আরও বলেন, "এইচ এন আশিকুর রহমান সংসদে বাজেট বরাদ্দ এনে তার ছেলে রাশেক রহমানের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিজেল এন্টারপ্রাইজকে কাজ দিয়েছেন। তবে কাজের মান কিংবা প্রকৃত বাস্তবায়ন হয়নি।"
মিঠাপুকুর ইকোপার্ক প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা ও অর্থ লোপাটের অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার বলে অনেকেই মনে করেন। বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার না হলে, এটি শুধুই একটি ব্যর্থ প্রকল্প হিসেবে থেকে যাবে। স্থানীয়দের প্রত্যাশা, প্রকল্পটি পুনরায় কার্যকর করা হোক এবং এলাকাবাসীকে কাঙ্ক্ষিত বিনোদনকেন্দ্র উপহার দেওয়া হোক।