যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ৩৪ বছর পর গ্রেপ্তার

১৯৮৭ সালে চরমপন্থী কর্তৃক নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থানায় একজন কনস্টেবল খুন এবং থানার মজুতকৃত অস্ত্র লুটের ঘটনায় খুনসহ ডাকাতি মামলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৩৪ বছর ধরে পলাতক আসামি চরমপন্থী সাইফুলকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ কারওয়ান বাজারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।
র্যাব জানায়, এ ঘটনায়, খুনসহ ডাকাতি মামলার ৩০ বছর যাবত পলাতক আসামি চরমপন্থী সাইফুল ইসলাম ওরফে মানিককে (৫৬) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব আরও বলছে, এই চরমপন্থীরা ওই সময় মিটিং করে সরকার বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পথে বাধা হয়ে দাড়ালে তারা পুলিশ বা তাদের সদস্যকে হত্যা করে থানা ফাঁড়ি লুট করে আতঙ্ক তৈরি করবে।
চরমপন্থী সাইফুল এ মামলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তার নেতৃত্বে থানা লুট করে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ঘটনার তদন্তে জানা যায়, ১৯৮৭ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি একদল চরমপন্থী ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরিহিত অবস্থায় হাতে পোটলা নিয়ে হাটের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে। তাদের পোটলার মধ্যে অস্ত্র লুকায়িত ছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক অস্ত্র প্রদর্শন করে টেলিফোন অফিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে দেয় এবং কয়েকজন থানায় জিডি করার উদ্দেশে থানায় প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে থানা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
এ সময়ে থানায় প্রহরারত কনস্টেবল হাবিবুর রহমান বাধা দিলে চরমপন্থীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে থানার অস্ত্রাগার লুট করে ২ টি এসএমজি, ৪ টি এসএলআর, ১৮টি ৩.৩ রাইফেল ও গোলাবারুদ লুট করে থানার লকআপে বন্দি চরমপন্থী আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তারপর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তারা একযোগে টেলিফোন অফিস ও থানা কম্পাউন্ডে বোমা বিষ্ফোরণ ঘটায়। তারপর তারা লুন্ঠিত মালামাল নিয়ে তাঁচকৈর হয়ে পূর্বদিকে গারিসাপাড়া হয়ে ধামাইর মাঠের দিকে চলে যায়।
র্যাব জানায়. এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থানার মামলা হয় মামলা নং-৯-১৯৮৭। মামলার তদন্ত শেষে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০ জন আসামি গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ৪৯ জনকে আসামি করে গুরুদাসপুর থানার চার্জশীট দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০০৭ সালে মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, র্যাব-৩ এর আভিযানিক দল একটি গোপন সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারে এ মামলায় একজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামি নারায়ণগঞ্জ এলাকায় আত্মগোপনে আছে। তারপর তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় এবং গোয়েন্দা নজরদারির মাধমে রাতে অভিযান পরিচালনা করে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ এলাকা হতে ছাত্তার নামে ছদ্মবেশে আত্মগোপন করা অবস্থায় সাইফুল ইসলাম ওরফে মানিককে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব আরও জানায়, আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, সে ১৯৮৪ সালে চরমপন্থী নেতা তারেকের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টি লাল পতাকা ওরফে সর্বহারা দলে যোগ দেয়।
চরমপন্থী নেতা তারেক প্রতি সপ্তাহে চাটমোহর এলাকায় উঠতি বয়সের যুবকদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে উঠান বৈঠক করত। ওই বৈঠকে সে আকর্ষণীয় কথাবার্তা বলত। সে বলত, তার দলে যোগ দিলে কোনো অভাব অনটন থাকবে না। তারা সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে। কেউ তাদের কাজে বাধা দিলে তাদেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে। যদি সরকার বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তবে তারা পুলিশ হত্যা করে থানা ফাঁড়ি লুট করবে। তাদের এরূপ আকর্ষণীয় কথায় মুগ্ধ হয়ে সে সক্রিয়ভাবে চরমপন্থীদের হত্যা, লুটপাট, ত্রাস সৃষ্টি, অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির কাজে অংশগ্রহণ করতে থাকে। চরমপন্থীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় এলাকায় সকলে তাকে সমীহ করত। যাদের সঙ্গে তার বিরোধীতা ছিল চরমপন্থীদের আশ্রয়ে থাকায় সকলে তার সঙ্গে আপোষ-মিমাংসা করে নেয়।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক আরও বলেন, চরমপন্থী নেতা তারেক উক্ত ঘটনার দুই মাস আগে থেকে গুরুদাসপুর থানা লুট করার পরিকল্পনা করে। এ জন্য সে ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ি, কুষ্টিয়া, পাবনা, টাঙ্গাইল এলাকা থেকে চরমপন্থী দলের সদস্যদের আহ্বান জানিয়ে একত্রিত করে। ঘটনার দিন তারা বিভিন্ন এলাকা হতে প্রায় ৬০ জন নাটোর, ধামরাইর মাঠে এসে জড়ো হয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরিহিত অবস্থায় পোটলার মধ্যে অস্ত্র লুকিয়ে গুরুদাসপুর থানা ও টেলিফোন অফিসের আশপাশ এলাকা এবং হাট এলাকায় অবস্থান নেয়। ঘটনার এক সপ্তাহ পূর্ব হতেই কয়েকজন সার্বক্ষনিক টেলিফোন অফিসের কর্মী এবং গুরুদাসপুর থানার ফোর্সের গতিবিধির উপর নজরদারি করছিল। তাদের সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্রই সুলতানের নেতৃত্বে ৫ জন টেলিফোন অফিসে প্রবেশ করে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে দেয়।
অন্যদিকে তারেকের নেতৃত্বে তিনিসহ প্রথমে ৪ জন জিডি করার জন্য থানায় প্রবেশ করে এবং মজিদের নেতৃত্বে ১০ জন থানা ব্যারাকে প্রবেশ করে সকল ফোর্সকে কক্ষের মধ্যে বন্দি করে রাখে। এ সময় ডিউটিরত কনস্টেবল হাবিবুর রহমান প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলে তারেক গুলি করে কনস্টেবল হাবিবুরকে হত্যা করে। গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে থানার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন তারেক অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে অস্ত্রাগার হতে সকল অস্ত্র, গোলাবারুদ লুটপাট করে এবং থানার লকআপে বন্দি চরমপন্থী দলের আটককৃত একজন সদস্য ইয়াকুবকে তালা ভেঙে মুক্ত করে। এরপর তারা বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে থানা কম্পাউন্ড এবং টেলিফোন অফিস ত্যাগ করে লুন্ঠনকৃত অস্ত্র নিয়ে হাটের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। হাটের মধ্যে অনেক লোক উপস্থিত থাকলেও কেউ তাদের বাধা দেওয়ার সাহস করেনি। তা ছাড়া, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের দলের সদস্যরা ভিড়ের মধ্যে ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিল। কেউ তাদের কাজে বাধা দিলে প্রতিহত করার পূর্ব প্রস্তুতি তাদের ছিল। লুণ্ঠনকৃত অস্ত্র তারেক, সুলতান, মজিদ এবং ইয়াকুব তাদের হেফাজতে নিয়ে চাটমোহর, চলনবিল এলাকায় লুকিয়ে রাখে।
র্যাব জানায়, এ ঘটনার শেষে সাইফুল তার বাড়িতে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকে। ১৯৮৮ সালে তারেকের নেতৃত্বে চাটমোহর থানার খোতবাড়ি এলাকায় মাঠের মধ্যে রাতে নকশালপন্থী এবং সর্বহারাদের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ঘটনায় নকশালপন্থী ১২ জন নিহত হন। ওই ঘটনার পর তিনিসহ সর্বহারা দলের সদস্যরা চলনবিলে গোসল করে যার যার বাড়িতে চলে যায়। ভোর হলে পুলিশ ১২টি লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়। ওই মামলায় সাইফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুদাসপুর থানার অস্ত্র লুটের সত্যতা বেরিয়ে আসে। ওই মামলায় সাইফুল জামিনে মুক্ত হয়ে পলাতক জীবন শুরু করে। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর সে আদালতে আর কোনো হাজিরা দেয়নি। তার নামে থানা লুট ও হত্যা মামলাসহ ৫টি মামলা রয়েছে।
কেএম/এমএমএ/
