যেভাবে জঙ্গি হয়ে উঠেন রমনায় বোমা হামলার আসামি মুফতি শফিকুর
রমনা বটমূলে বোমা হামলা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি শফিকুর রহমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নাম পাল্টে ছদ্মবেশ ধারণ করে ২১ বছর আত্মগোপনে ছিলেন। ২০০৮ সালে নিজের নাম পরিবর্তন করে নতুন রুপে জাতীয় পরিচয়পত্র বানান তিনি। শফিকুর রহমান নরসিংদীর একটি নিভৃত চরে বসবাস করতেন।
তাকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব বলছে, শফিকুর রহমান নাম পরিবর্তন করে কখনো আব্দুল করিম আবার কখনো শফিকুল ইসলাম নাম ধারণ করে দীর্ঘদিন ধরে মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। সেখানকার মসজিদে ইমামতি করে আসছিলেন।
গোয়েন্দারা বলছেন, ধরা পড়ার ভয়ে তিনি তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। শুধু ছেলের (পরিবার) সঙ্গে গোপনে মাঝে মাঝে দেখা করতেন। সেই সূত্র ধরে গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন তাকে নজরে রাখে এবং এক পযার্য়ে জানতে পারে তিনি ২১ বছর আত্মগোপনে রয়েছেন।
কে এই মুফতি শফিকুর রহমান
শফিকুর রহমান নিজ গ্রাম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর মাদরাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। ঢাকার চকবাজারে একটি মাদরাসা থেকে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৮৩ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল) পাস করে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে ইউসুফ বিন নুরি মাদরাসায় ফতোয়া বিভাগে ভর্তি হয়ে তিন বছরের ইফতা (ফতোয়া) কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে অবস্থানকালীন আফগানিস্তানে চলে যান এবং তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। পরে ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে আসার পর তিনি ঢাকার খিলগাঁওয়ে একটি মাদরাসায় পার্ট টাইম শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচির নিউ টাউনে পড়াশোনা করার সময় সেই প্রতিষ্ঠানে মুফতি হান্নানও পড়াশোনা করতে গেলে তার সঙ্গে পরিচয় হয়।
আফগানিস্তানে ভ্রমণে গিয়ে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা
পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে ভ্রমণে গেলে আফগানিস্তানে থাকাকালীন জঙ্গি সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদের’সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। আফগানিস্তান থেকে দেশে এসে ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ সালে দেশে ফেরত এসে সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ এর প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি হরকাতুল জিহাদের আমির ছিলেন। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি হরকাতুল জিহাদের শূরা সদস্য ছিলেন।
শফিকুর রহমান ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর থানাধীন বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত এবং শতাধিক লোক আহতের ঘটনায় সম্পৃক্ত আসামি। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রমনা বটমূলে হামলার পর তিনি আত্মগোপনরত অবস্থায় সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। পরে তিনি পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন মাদরাসায় শিক্ষকতা ও মসজিদে ইমামতি করেন।
রমনা বটমূলে বোমা হামলা
২০০১ সালের পয়লা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালে প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের অতর্কিত বোমা হামলায় ১০ জন মৃত্যুবরণ করেন এবং আরও অনেকে আহত হন। এ ঘটনায় রমনা থানায় একটি হত্যা মামলাসহ অপর একটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। হত্যা মামলাটির বিচার শেষে ২০১৪ সালের ২৩ জুন আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। এই মামলায় মুফতি শফিকুর রহমানের মৃতুদণ্ড হয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একটি জনসভা চলাকালে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা হয়। সেই গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন এবং তিন শতাধিক গুরুতর আহত হন। সেই ঘটনায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য বেঁচে যান। এ ঘটনায় ঢাকার মতিঝিল থানায় একটি হত্যা ও হত্যা চেষ্টার সহযোগিতাসহ দুটি পৃথক মামলা হয়। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মুফতি শফিকুর রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
একই ঘটনায় ঢাকার মতিঝিল থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে অপর একটি মামলা হয়। মুফতি শফিকুর রহমান বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায়ও পলাতক আসামি। এছাড়াও ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর থানাধীন বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত এবং শতাধিক লোক আহত হন। গ্রেপ্তারকৃত শফিকুর রহমান কিবরিয়া হত্যা মামলায়ও চার্জশিটভুক্ত আসামি। তার বিরুদ্ধে ভৈরব থানায় সর্বমোট ছয়টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নরসিংদীর একটি নিভৃত এলাকার চরে মাদরাসায় শিক্ষকতা করার পাশাপাশি মসজিদে ইমামতি করতেন তিনি। ২০০৮ সালে নিজের নাম বদলে ফেলেন। আব্দুল করিম নামে সেই চরের মসজিদে ইমামতি করতেন এবং একটি মহিলা মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। মহিলা মাদরাসায় শিক্ষকতা করার সময় পর্দার আড়ালে থেকে তিনি কথা বলতেন। এই কারণে কেউ তার মুখ দেখতে পেত না। একারণে আত্মগোপন করাটা তার পক্ষে সহজ ছিল। তিনি বিভিন্ন মসজিদে উগ্রবাদী বক্তব্য দিতেন বলে এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে। তার সঙ্গে পরিবারের কারও সাক্ষাৎ হতো না। শুধু তার ছেলে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখা করতেন।
তিনি বলেন, শফিকুর রহমান প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের জানিয়েছেন, ২০০৮ সালের পর থেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি। নরসিংদীর একটি চরে মাদরাসায় চাকরি নেন এবং ইমামতি করতে থাকেন। এর মাঝে কয়েক দফা তার ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি ছেলে ছাড়া পরিবারের আর কারও সঙ্গে দেখা করতেন না। এই সময়গুলোতে তিনি বিভিন্ন মাহফিলে উগ্রবাদি বক্তব্য দিতেন। তবে হরকাতুল জিহাদসংক্রান্ত কোনো কাজ করেননি বলে জানিয়েছেন।
তার কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, আমরা তার কাছ থেকে কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র পাইনি। ভুয়া পরিচয়ে তিনি ওয়াজ মাহফিল করতেন এবং একটি মাদরাসায় আব্দুল করিম নামে চাকরি করেছেন। তার জাতীয় পরিচয়পত্র বদল করা হয়েছে ২০০৮ সালে। আল মঈন বলেন, তিনি যেহেতু একটি মাদরাসায় ইমামতি করতেন আমরা তাকে বাইরে চলাচলরত অবস্থায় রাস্তা থেকে গ্রেপ্তার করেছি। পরে মাদরাসায় গিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। তিনি বিভিন্ন উগ্রবাদী বক্তব্য রেখেছেন, তা এলাকাবাসী আমাদের জানিয়েছেন। তবে এই সময়টুকু হরকাতুল জিহাদের কার্যক্রম থেকে দূরে ছিলেন তিনি।
রমনার বটমূলে হামলা সংক্রান্ত কি তথ্য পেয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মঈন বলেন, ‘আমরা তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত হামলা সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাইনি। তবে তাদের শূরা কমিটিতে এ সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। পাশাপাশি হামলার পরিকল্পনা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে তার কাছ থেকে।
কেএম/আরএ/