মহাসড়কের জমি জাল করে ১৫ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ!
যেনতেন প্রতারণা নয়, মহাসড়কের জমি কেনাবেচা করতেন তিনি। সেই জমি বন্ধক রেখে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকার ব্যাংক লোন। লোন পরিশোধ করতে না পারায় জমি উঠে নিলামে। এরপর বেড়িয়ে পড়ে থলের বিড়াল। জানা যায়, মহাসড়কের সরকারি জমি জালিয়াতি করে লিখে নেওয়া হয়েছে নিজের নামে। এমন সব প্রতারণা, জালিয়াতি, হত্যাচেষ্টার আসামি র্যাবের জালে ধরা পড়েছেন। তার নাম মো. গোলাম ফারুক। একই সঙ্গে তার প্রধান সহযোগী ফিরোজ আল মামুনও গ্রেপ্তার হয়েছেন। রাজধানীর উত্তরা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) রাতে র্যাব-১ অভিযান চালিয়ে রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে।
র্যাব জানায়, সম্প্রতি বাড্ডা থানাধীন মেরুল বাড্ডা এলাকায় জাল দলিল সংক্রান্ত বিরোধের কারণে পরস্পর যোগসাজশে একটি হত্যা চেষ্টার ঘটনা ঘটে। যেখানে ভিকটিমকে নিজ জমি থেকে জোরপূর্বক উৎখাত করার চেষ্টা করে প্রতারক গোলাম ফারুক ও তার প্রধান সহযোগী ফিরোজ আল মামুনসহ অন্যান্যরা। গত ২৬ মার্চ ও চলতি ৬ এপ্রিল বাদীদের উপর হত্যার উদ্দেশে হামলা করে তারা। ওই ঘটনায় ভিকটিম আদালতে একটি নালিশি দরখাস্ত করলে আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে বাড্ডা থানাকে এটিকে এফআইআর হিসেবে গণ্য করার আদেশ দেন এবং বাড্ডা থানায় এ বিষয়ে একটি মামলা দায়ের হয়। এরপর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে এবং এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে দুই জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সব তথ্য জানান র্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজধানীর বাড্ডায় হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। এছাড়াও মহাসড়কের জমি কেনাবেচা করে প্রতারণামূলকভাবে ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে প্রতারিত করার বিভিন্ন বিষয়াদি ও কৌশল সম্পর্কেও স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০২১ সালের এপ্রিলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মহাসড়কের জমি ব্যক্তির নামে নিবন্ধন, বিক্রি, ব্যাংকে বন্ধক ও ব্যাংক কর্তৃক নিলামে বিক্রি চেষ্টার ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। এই ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তপর্ষদ গঠিত হয়। এ তদন্তে উল্লেখ করে যে একটি প্রতারক চক্র মহাসড়ক শ্রেণিভুক্ত সরকারি জমি কয়েকটি সরকারি অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে সরকারি ভূমি ব্যক্তি মালিকানায় নিবন্ধন করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নেন। যদিও, এসব জমি সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর এল. এ কেস ১৩-১৯৪৮/৪৯ সালের মূলে ও পুনরায় ৬৬-১৯৫৭/৫৮ সালের মূলে অধিগ্রহণ করা হয়।
তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার গোলাম ফারুক জানান, তিনি ২০০০ সাল থেকে গাড়ি আমদানিকারক হিসেবে তার ব্যবসা শুরু করে। এরই প্রেক্ষিতে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কোনো বন্ধকি সম্পত্তি ব্যতিত এলসি আবেদন করে গাড়ি আমদানি শুরু করেন। বিদেশি ব্যাংকের টাকার পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকায় বেসরকারি ব্যাংকটি আমদানিকৃত গাড়ি বিক্রি করে ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করার শর্তে তাকে ৭ কোটি টাকা ডিম্যান্ড লোন দেয়। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংক তাকে সম্পত্তি বন্ধক দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করলে তিনি সরকারি জমিকে অসদুপায়ে ব্যক্তির নামে নিবন্ধন করার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ১৯৪৮ সালে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ হওয়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উত্তরার আজমপুর অংশের অধিগ্রহণ হওয়ার পূর্বের জমির মালিকের ছেলেকে খুঁজে বের করেন। জালিয়াতির করে তিনি ২০০৬ সালে মিথ্যা তথ্য দিয়ে একটি ভুয়া দলিল তৈরি করেন। এরপর দলিলমূলে তৎকালীন মালিকের ছেলের কাছে গ্রেপ্তারকৃত গোলাম ফারুক তার স্ত্রীর নামে ২০১০ সালে নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করে আরেকটি দলিল তৈরি করেন। একই বছরে তার স্ত্রী থেকে ওই জমি নিজের নামে দলিল করে নেন। যার সাফ কবলা দলিল করে।
র্যাব জানায়, পরবর্তীতে ওই জমি বেসরকারি ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে তিনি ব্যাংক থেকে আরও ১৫ কোটি টাকা ঋণ নেন। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করায় ২০১৩ সালে ব্যাংক অর্থ আদায়ের উদ্দেশে বন্ধকি জমি নিলামে বিক্রি করার নোটিশ জারি করলে ব্যাংক সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পায় যে ওই জমিটি সরকারি সম্পত্তি। তিনি অসৎ উপায় অবলম্বন করে একটি ভ্রম সংশোধন দলিল করে পূর্বের বন্ধককৃত জমির দাগ নম্বর পরিবর্তন করে মামলার বাদীর জমির দাগ নম্বর উল্লেখ করেন। তখন ব্যাংক সেই জমিতে বন্ধকি সম্পত্তির সাইনবোর্ড স্থাপনের চেষ্টা করলে প্রতারণার বিষয়টি উন্মোচিত হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তারকৃত গোলাম ফারুক এর বিরুদ্ধে জমি জমা সংক্রান্ত, প্রতারণা, হত্যা চেষ্টা, এনআই অ্যাক্ট, জালিয়াতি ইত্যাদি অপরাধে রাজউক এর ১টি, একটি বেসরকারি ব্যাংক এর ৪টি ও পাবলিক বাদী হয়ে ৩টিসহ মোট ৮টি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ফিরোজ আল মামুন ওরফে ফিরোজ হল, গোলাম ফারুকের সব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী। তিনি উত্তরা এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ বিস্তারে কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক বলে অভিযোগ রয়েছে।
গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
কেএম/আরএ/