চিত্রনায়ক সোহেল খুনের কারণ জানালো র্যাব
দীর্ঘ ২৪ বছর পূর্বে চাঞ্চল্যকর ও বহুল আলোচিত জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার পলাতক ও চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামি আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাব জানিয়েছে, কানাডা পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন আশিষ।
র্যাব বলছে, বনানীর আবেদীন টাওয়ারে আশিষ রায় চৌধুরী এবং আসাদুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম এর যৌথ মালিকানায় ট্রাম্পস্ ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ওই ক্লাবে বিভিন্ন বয়সী মানুষ সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য আসত। এখানে সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিল আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের। আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় চৌধুরী একসাথে ট্রাম্পস্ ক্লাবে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড ও অপরাধ জগতের ব্যক্তিদের সাথে জড়িত থেকে তারা বিভিন্ন ধরণের অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করত।
র্যাব জানায়, ট্রাম্পস্ ক্লাবের ঠিক পাশেই ছিল ঐ সময়কার বনানীর সবচেয়ে বড় মসজিদ বা বনানী জামে মসজিদ। ট্রাম্পস্ ক্লাবের এই অসামাজিক কর্মকান্ডে ভিকটিম চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী বনানী মসজিদের মসজিদ কমিটি নিয়ে বার বার ট্রাম্পস্ ক্লাবের এই ধরণের অশ্লীলতা বন্ধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে ভিকটিমের তর্ক এবং এক পর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ট্রাম্পস্ ক্লাবে তৎকালীন শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ট্রাম্পস্ ক্লাবে জনসম্মুখে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে সোহেল চৌধুরী অপমান করার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বান্টি ইসলাম, আশিষ রায় চৌধুরী ও আজিজ মোহাম্মদ ভাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনকে দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে হত্যার প্রস্তাব দেয়। ইমন তাদের সাথে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সোহেল চৌধুরীকে হত্যার প্রস্তাবে রাজি হয় এবং পরবর্তীতে ইমন এই হত্যাকান্ড ঘটায়।
মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর গুলশানের ২৫-বি ফিরোজা গার্ডেন নামের একটি বাসা থেকে আশিষকে গ্রেপ্তার করা হয়। বুধবার (৬ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এসময় র্যাব ২২ বোতল বিদেশি মদ, ১৪ বোতল সোডা ওয়াটার, ১ টি আইপ্যাড, ১৬টি বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড, ২টি আইফোন ও নগদ ২ লাখ টাকা জব্দ করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব মিডিয়া পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ১৯৯৬ সালে বনানীর আবেদীন টাওয়ারে আশিষ রায় চৌধুরী এবং আসাদুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম এর যৌথ মালিকানায় ট্রাম্পস্ ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে ৫০ লাখ টাকার পুঁজি নিয়ে ট্রাম্পস্ ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ৫০ লাখ টাকার মধ্যে ২৫ লাখ টাকা লগ্নি করেছিলেন আশিষ রায় এবং অবশিষ্ট ২৫ লাখ টাকা লগ্নি করেছিলেন পলাতক বান্টি ইসলাম।
র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার মঈন বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ক্লাবে বিভিন্ন বয়সী মানুষ সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য আসত। গ্রেপ্তার আশিষ ১৯৯৬ সাল থেকেই এই ক্লাবে বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ করে আসছিল। পর্যায়ক্রমে এই ট্রাম্পস্ ক্লাবটি সকল আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন এবং গ্যাং লিডারদের একটি বিশেষ আখড়ায় পরিণত হয় এবং এখানে সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিল আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের। আজিজ মোহাম্মাদ ভাই মূলত ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের চক্রগুলোর সাথে বিভিন্ন ধরণের মিটিং বা তাদের পরিচালনা করার জন্য সেই ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত করত এবং সেই ক্লাবকে ব্যবহার করত। সেই সুবাদে ট্রাম্পস্ ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম এবং আশিষ রায় চৌধুরীর সাথে তার সখ্যতা তৈরি হয়।
তিনি বলেন, আজিজ মোহাম্মদ ভাই এর ভাতিজিকে বান্টি ইসলাম বিয়ে করার সুবাদে তাদের মধ্যে একটি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল এবং বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় তারা যুবক বয়স থেকে একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরবর্তীতে তাদের এই বন্ধুত্ব ব্যবসায়ীক অংশীদারিত্বে রূপ নেয় এবং একসাথে পার্টনারশীপে ট্রাম্পস্ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে পরিচালনা করা শুরু করে। আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় চৌধুরী একসাথে ট্রাম্পস্ ক্লাবে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড ও অপরাধ জগতের ব্যক্তিদের সাথে জড়িত থেকে তারা এই ধরণের অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করত।
র্যাব আরও জানায়, যেহেতু এই ট্রাম্পস্ ক্লাবে সন্ধ্যা থেকে শুরু করে সারারাতব্যাপী বিভিন্ন ধরণের অসামাজিক কর্মকান্ড পরিচালিত হত, ভিকটিম চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী বনানী মসজিদের মসজিদ কমিটি নিয়ে বার বার ট্রাম্পস্ ক্লাবের এই ধরণের অশ্লীলতা বন্ধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ভিকটিম সোহেল চৌধুরীর মসজিদ কমিটি নিয়ে এই ট্রাম্পস্ ক্লাবের অশ্লীলতা ও অসামাজিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে ট্রাম্পস্ ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম এবং আশিষ রায় চৌধুরীর ব্যবসায়িক স্বার্থে মারাত্মকভাবে আঘাত হানে।
র্যাব মুখপাত্র মঈন বলেন, আজিজ মোহাম্মদ ভাই যেহেতু আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেক্টিভিটি মেইনটেইন করার জন্য ঢাকায় ট্রাম্পস্ ক্লাবকে একটা সেইফ হাউজ হিসেবে বেছে নিয়েছিল তার সেই স্বার্থেও আঘাত লাগে। আবার ইমনের মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও যেহেতু অসামাজিক কার্যকলাপ করতে একমাত্র সেইফ হাউজ পেয়েছিল, ঐ সময়ে যদি ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যেত তাহলে তারা সকলেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ত। সব ধরণের অসামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই ট্রাম্পস্ ক্লাব।
র্যাব জানায়, চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ঐ সময় সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মসজিদ কমিটির পক্ষ হয়ে এই ট্রাম্পস্ ক্লাবটি বন্ধ করতে বার বার চেষ্টা করায় এই সকল গ্রুপের অর্থাৎ ব্যবসায়িক বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় চৌধুরী, আজিজ মোহাম্মদ ভাই এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন এর চক্ষুশূলে পরিণত হয়। এই ঘটনায় গত ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে ভিকটিমের সরাসরি তর্ক এবং এক পর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে আজিজ মোহাম্মদ ভাই সোহেল চৌধুরীর উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় চৌধুরীকে অনুরোধ জানায়।
সর্বশেষ ২৮ মার্চ আশিষ রায় চৌধুরীর নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলে সে আগামী ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে কানাডায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। পরবর্তীতে তাকে রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান র্যাব কর্মকর্তা কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।
কেএম/এএস