বেড়েছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডসহ খুনের ঘটনা
সম্প্রতি রাজধানীসহ সারা দেশেই বেড়ে গেছে খুনের ঘটনা। ব্যক্তিগত বিরোধ, পারিবারিক কলহ, আধিপত্য বিস্তার, মাদক বাণিজ্য ও চুরি-ডাকাতিতে বাধা দেওয়ায় ঘটছে এসব হত্যাকাণ্ড। পাশাপাশি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও বেড়েছে ভয়াবহভাবে।
২৪ মার্চ রাত ১০ টার দিকে শাহজাহানপুরে ব্যস্ত সড়কে মাইক্রোবাসে করে বাসায় ফেরার পথে গুলি করে হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। এ ঘটনায় গুলিতে প্রীতি নামে রিকশাযাত্রী এক কলেজছাত্রীও নিহত হন।
২৭ মার্চ ভোরে নোয়াখালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন দন্ত্য চিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুল। পরে রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে বের হয়ে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন তিনি।
২৬ মার্চ বিকালে রাজধানীর সবুজবাগ থানার দক্ষিণগাঁও বেগুনবাড়ি এলাকায় এসি মেরামতের কথা বলে কয়েকজন দুর্বৃত্ত ঘরে ঢুকে ডাকাতির চেষ্টা করে। এতে তানিয়া আফরোজ মুক্তা বাধা দিলে ওই নারীকে নিজ ঘরে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ওই দিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় সবুজবাগ থানা পুলিশ। পরে তারা জানতে পারে স্কচটেপে তার দুই সন্তানের মুখ বেঁধে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে খুন করে দুর্বৃত্তরা।
ডিএমপির সূত্র জানায়, এ বছরের জানুয়ারিতে শুধমাত্র ঢাকাতে হয়েছে ৯ খুন। ফেব্রুয়ারিতে ১২টি খুন। এর মধ্যে ৫ টি খুনের ঘটনাই মিরপুর এলাকায়। চলতি মাসের (২৮ মার্চ) প্রযর্ন্ত আলোচিত একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে রাজধানীতে ৩ হাজার ৩৭৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বছরে গড়ে ২৫০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এ সময়ে।
আবার পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ১৫ হাজার ৩০৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গড়ে প্রতিবছর ৩ হাজার ৮২৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটে।
অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬৭৬টি। এ হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমলেও ২০২১ সালে তা আবার কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ওই বছর ১৫৭টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা পূর্ববর্তী চার বছরের গড় সংখ্যার তিনগুণেরও বেশি।
এদিকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়া হতো। ২০১৯ সালে আংশিক তথ্য দেওয়া হলেও এর পর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত আর কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এতে কী পরিমাণ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং কতগুলোর বিচার সম্পন্ন হয়েছে সে তথ্য পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এতে অপরাধের প্রকৃত চিত্রও জানা সম্ভব হচ্ছে না। একে এক ধরনের ‘লুকোচুরি’ বলছেন অনেকে। তবে এটি লুকোচুরি নয় দাবি করে তথ্য অধিকার আইনে নিয়ম মেনে আবেদন করলে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশযোগ্য সব তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
এছাড়া, ডিএমপির একটি তথ্য বলছে, চলতি বছরের গত দুই মাস ২৭ দিনে রাজধানীতে ৩৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১২ জন ও মার্চ মাসের প্রথম ২৭ দিনে ১৩ জন খুন হয়। এর মধ্যে কতগুলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সেটির হিসাব নেই।
তবে আসকের তথ্যে দেখা গেছে, এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩৯টি। শুধু জানুয়ারিতেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২৯টি। ২০২১ সালে প্রতিমাসে এই হত্যাকাণ্ডের গড় সংখ্যা ছিল ১৩। এ হিসাবে গত জানুয়ারিতে তিনগুণ বেড়েছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।
আসকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সারা দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৫৭টি, ২০২০ সালে ৩১টি, ২০১৯ সালে ৩৯টি, ২০১৮ সালে ৬৭টি, ২০১৭ সালে ৫২টি, ২০১৬ সালে ১৭৭টি ও ২০১৫ সালে ১৫৩টি। এতে আরও দেখা যায়, ২০১৬ সালে ১৭৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ২০১৭ সালে হত্যার ঘটনা কমে ৫২টি তে দাঁড়ায়। পরে ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালেও এ সংখ্যা কম ছিল। এই তিন বছর গড়ে ৪৫টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে হঠাৎ ২০২১ সালে আবারও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ওই বছর ১৫৭টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা পূর্ববর্তী তিন বছরের গড় সংখ্যার তিনগুণেরও বেশি।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন জানান, সারাদেশে হত্যাকাণ্ড বাড়ছে নাকি কমছে সেটা তথ্য নির্ভর সংখ্যাগত একটি বিষয়। তবে বলা যায়, হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সামগ্রিকভাবে আগের মতোই আছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেশকে গ্রাস করায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, তথ্য লুকোচুরির কোনো সুযোগ নেই। প্রত্যেকটি ঘটনার পর সেটি স্থানীয় বা জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইট আপডেট হওয়ায় সেখানে তথ্য দেওয়ার অপশনটি নেই। এ ছাড়া তথ্যগুলো যেখান থেকে একত্রিতভাবে আসত, সেটি না আসায় হয়তো এমনটি হয়েছে। কেউ তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে নির্দিষ্ট সময়ে তথ্য পাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালক (মিডিয়া) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা সব সময় বিভন্ন হত্যাকান্ডের আসামিদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে বহুল আলোচিত এবং চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, সাম্প্রতি রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় জাহিদুল ইসলাম টিপু ও সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড এবং টিপুকে অনুসরণকারীসহ ৪ জনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এ হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি মুসা টিপু হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে দেশের বাইরে চলে যায় এবং সেখানে বসে সে এটি বাস্তবায়ন করে। তছাড়া অনেকেই এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে অনেকে জড়িত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হত্যাকাণ্ডের মোটিভ বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানিয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ ভিকটিম ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান ছিল। মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ে এ হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক ভাবে মিল্কী হত্যার প্রতিশোধ নিতে টিপুকে হত্যা করা হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তিনি বলেন, মাত্র ১৫ লাখ টাকায় টিপুকে হত্যা করা হয়। তবে এ ঘটনার মূল আসামি দেশের বাইরে থাকায় তাকে ধরতে পারেনি গোয়েন্দারা।
খন্দকার মঈন বলেন, মানুষ যখন বিভিন্ন ধরণের ঝামেলায় পড়ে বা মনে করে তখন তাকে আইনের অনুসারী হওয়া উচিত। অনুসারী এবং সর্তক হলে অনেক ধরণের অপরাধ কমে আসবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, সারাদেশে হঠাৎ করে খুনের ঘটনা বেড়ে গেছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় রাজনৈতিক ও পারিবারিক কলহের কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক ও স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে খুনোখুনিসহ সব ধরনের অপরাধ বেশি হচ্ছে।
তিনি বলেন, নাগরিকদের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের নাগরিক বিবেচনায় না হয়ে অবস্থানের ভিত্তিতে হয়ে গেছে। একইভাবে রাজনীতি ‘আদর্শের’ বদলে ‘ক্ষমতাকেন্দ্রিক’ হওয়ায় দেশ অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। তার মতে, অপরাধের সঠিক তথ্য জানা নাগরিকদের অধিকার। এর ফলে অপরাধের প্রকৃত চিত্র জানাসহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ করণীয় ঠিক করা সম্ভব হবে। কিন্তু এটা নিয়ে ‘লুকোচুরি’ করা হলে অপরাধীরাই বেশি সুযোগ পাবে।
এসব অপরাধ দমনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর আরও তৎপর হতে হবে। এবং ভুক্তভোগীদের তথ্য আমলে নিয়ে তাদের কাজ করতে হবে তাহলে এসব অপরাধ অনেকটা কমে আসবে মনে করেন এই অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
কেএম/কেএফ/