ঢাকায় হঠাৎ বেড়েছে খুন-চুরি-ছিনতাই
রাজধানী ঢাকা হঠাৎ করে অস্থির হয়ে উঠেছে। নগরজুড়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খুন-চুরি-ছিনতাই। আর এই চুরি-ছিনতাই ও খুন রোধে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যার কবলে পড়ে নিরীহ মানুষকে জীবন দিতে হচ্ছে। এসব ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে গুরুতর আহত হওয়ার পাশপাশি ঘটছে প্রাণহানি।
এ ঘটনায় ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে রাজাধানীতে প্রাণ হারিয়েছেন ৮ জন। তা ছাড়া এসব চুরি ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে দুইমাসে আহত হয়েছেন ৫০ এর অধিক মানুষ। তারা প্রায় সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুলিশ সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সূত্রটি জানায়, চলতি বছরের এই ৩ মাসে সারা ঢাকাতে বেড়েছে খুন চুরি-ছিনতাই।
গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু মাইক্রোবাসে করে শাহজাহানপুর আমতলা কাঁচাবাজার হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। শাহজাহানপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে পৌঁছালে হেলমেট পরা দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে টিপু ও তার গাড়িচালক মুন্না গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় জাহিদুলের গাড়ির পাশ দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী প্রীতি। তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক টিপু ও প্রীতিকে মৃত ঘোষণা করেন। গুলিবিদ্ধ গাড়িচালক মুন্না বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শনিবার (২৬ মার্চ) রাজধানীর সবুজবাগের একটি বাসায় দুই শিশুসন্তানের মুখ বেঁধে রেখে তাদের মা মুক্তা আক্তারকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এরপর রবিবার (২৭ মার্চ) ভোরে (দুর্বৃত্ত) আবার ছিনতাইকারির ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেছে আহমেদ মাহী বুলবুল নামের এক দন্ত চিকিৎসকের। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে।
ছিনতাইয়ের এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের অনেকের অভিযোগ-ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রতিকারও মেলে কম। কারণ, ঘটনার পর ভুক্তভোগীদের অভিযোগ বা মামলা না করা।
এদিকে ডিএমপি কমিশনার জানিয়েছেন, পুলিশকে খুন চুরি-ছিনতাই ঠেকাতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে, এসব একেবারে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভর নয়।
সম্প্রতি দীর্ঘ সময় ধরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একাধিক ছিনতাইয়ের পর নির্বিঘ্নে এলাকা ত্যাগ করে ছিনতাইকারী দল। পরে চক্রটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়। আটককৃতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করছে গোয়েন্দারা।
মোহাম্মদপুরেই ভিন্ন কায়দায় দুর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের শিকার হন এক যুবক। আহত হওয়ার পর কয়েকদিন হাসপাতালেও থাকতে হয়েছে। ঘটনায় জড়িতরা আটক হয়েছে।
ভুক্তভোগী মো. রুমান খান জানান, ছিনতাইকারীরা তার কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিতে গেলে তিনি বাধা দেন। তখন চাপাতি দিয়ে তার হাত ও মাথায় আঘাত করে।
গত মাসে কাওরান বাজার বাংলাভিশনের অফিস ভবনের বিপরীতে পার্শ্বে ছিনতায়ের শিকান হন আনিসুর রহমান। তার কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নেয় তারা। এরপর আনিসকে ছুরি মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়। পরে পুলিশ আনিসকে ঢাকা মেডেকেল হাসপাতালে নিয়ে যায়।
উত্তরার সানজিদা রাফসান জনি নামে এক নারী ভুক্তভোগী জানান, ছিনতাইকারী তার হাতের ব্যাগ ছিনিয়ে নিতে গেলে তার হাতে আটকে যায়। তখন সেই ছিনতাইকারীদের প্রাইভেটকারটি তাকে টেনে হিঁচড়ে কয়েকশ মিটার দূরে নিয়ে যায়।
ছিনতাইয়ের ঘটনায় গেল কয়েক বছরের পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে--২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা মহানগরীতে মামলা হয় ১৪৫টি, ২০২০ সালে ১৭৬টি, ২০১৯ সালে ১৫৫টি, ২০১৮ সালে ২১৬টি, ২০১৭ সালে ১০৩টি, ২০১৬ সালে ১৩২টি, ২০১৫ সালে ২০৫টি ও ২০১৪ সালে ২৬৫টি মামলা দায়ের হয়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ১৩টি। এ ছাড়াও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ১০টি।
তবে এসব ঘটনায় শুধু থানার মামলার হিসাব এগুলো। বাস্তবে ছিনতাই ও খুনের ঘটনা আরও বেশি।
এদিকে অভিযোগ দিতে গিয়েও ভুক্তভোগীদের আছে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা। ভুক্তভোগীরা জানান, পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিনতাইয়ের ঘটনা হারিয়ে যাওয়ার নামে সাধারণ ডায়েরি করে এবং এর আর কোনো আপডেট পাওয়া যায় না।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত রাজধানী ঢাকায় সুযোগ পেলেই ছিনতাইকারী চক্র ছোঁ মেরে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত নগরীতে ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনা ঘটে। পথে পথে ওঁৎ পেতে থাকা ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা দিনে-দুপুরেও ছিনতাই করে। গত মাসে এবং চলতি মাসে হঠাৎ ঢাকাতে খুন, চুরি, ছিনতাই চক্রের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছে পুলিশ।
ওই সূত্রটি নিশ্চিত করে বলেন, রাজধানীতে খুনি ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেন তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। দিন-রাতের যেকোনো সময়েই খুন-চুরি-ছিনতাইয়ের শিকার হতে হচ্ছে তাদের। এসব ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
গতমাসে রাজধানীর মিরপুর বাউনিয়াবাঁধ ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে রায়হান (২৫) নামে এক পোশাককর্মী নিহত হয়েছেন। তার মরদেহ ঢাকা মেডিেকল কলেজের মর্গে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় পল্লবী থানা পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
মোশারফ হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী রাজধানীর শ্যামবাজারে মালামাল কিনতে যাচ্ছিলেন। সায়েদাবাদ ফ্লাইওভার ঢাল থেকে দয়াগঞ্জের দিকে যাওয়ার সময় সড়কে ছিনতাইকারীর পাল্লায় পড়েন তিনি। তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ জানিয়েছেন, মোশারফ একজন ভ্রাম্যমাণ হলুদ, মরিচ ও মসলা বিক্রেতা ছিলেন। শ্যামবাজারে মালামাল কিনতে যাওয়ার পথেই ছিনতাইয়ের শিকার হন। তার বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। ওই রাতেই যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ মোশারফের হত্যাকারী দুই ছিনতাইকারী সজীব (২০) ও শাকিলকে (২০) গ্রেপ্তার করে। তারা এর আগেও যাত্রাবাড়ীতে একটি ছিনতাইয়ে হত্যা মামলার আসামি ছিল।
আদালত থেকে জামিনে তারা বের হয়ে ফের ছিনতাই কাজে নেমেছে। এর পেছনে আর কেউ জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হঠাৎ করে খুন চুরি ছিনতাই বেড়ে গেলেও কর্তব্যরত মাঠ পর্যায়ের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার ৫০ থানা এলাকার বেশিরভাগ স্থানেই রাত ১০টার পর সড়কে কোনো পুলিশ থাকে না। টহল পুলিশের গাড়িও চোখে পড়ে না বলে ভুক্তভোগীদের দাবি। ফলে অরক্ষিত সড়কে রিকশা আরোহীসহ চলাচলরত সাধারণ মানুষ ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছেন। এসব ছিনতাই ঘটনার শিকার বড় একটি অংশ থানা পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না।
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন নামে একজন ভুক্তভোগী বলেন, রাত ১টার দিকে মোটরসাইকেলে করে মিরপুর থেকে সূত্রাপুর যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময়ে সড়কে কোনো পুলিশকে দেখতে পাননি তিনি। মিরপুর থেকে সূত্রাপুরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। এই বিশাল দূরত্বে কোনো টহল পুলিশ না দেখতে পেয়ে অনেকটা ভয়ও পেয়েছিলেন তিনি। সূত্রাপুরে দুজন ছিনতাইকারী মোটরসাইকেল থামিয়ে ফোন আর মানিব্যাগে থাকা টাকা নিয়ে চলে যায়। ‘পুলিশের বাড়তি ঝামেলা এড়াতে’ মামলা করেননি বলে জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) হাফিজ আল আসাদ বলেন, সারাদেশে হত্যা চুরি ছিনতাইয়ের মৌসুম চলছে মনে হয়। এসব অপরাধ দমনে ও চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের পুলিশের বিভিন্ন অভিযান চলমান রয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, সারা ঢাকাতে খুন, চুরি, ছিনতাই প্রতিরোধে গোয়েন্দা পুলিশের প্রায় ৭০টির মতো টিম পুরো ঢাকা শহরে দায়িত্ব পালন করছে। এর মধ্যেও কিছু ঘটনা ঘটছে যা একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে বেশিরভাগ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কয়েকটি ঘটনায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা শীঘ্রই তাদেরও গ্রেপ্তার করতে পারব।
পুলিশের দাবি, খুন চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়লেও তা এখনো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ ঘটনায় আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি দুয়েকটি ঘটনায় তদন্তের কাজ অব্যাহত রয়েছে।
এ সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, সম্প্রতি আমরা কয়েকটি খুন চুরি ও ছিনতাই চক্রকে আইনের আওতায় আনতে আমরা সক্ষম হয়েছি। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি।
র্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাব সব সময় বিভিন্ন অপরাধ দমনে তৎপর রয়েছে। সারাদেশে হঠাৎ খুন, চুরি ও ছিনতাই রেড়ে যাওয়ায় আমরা অতিরিক্ত গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছি। ও এ ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি।
তিনি বলেন, সম্প্রতি অনেক চুরি ছিনতাই চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা সক্ষম হয়েছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ব্যস্ত শহরে ছিনতাই একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। খুন-চুরি-ছিনতাই রোধে সবাই সচেতন হবে। তাহলে এসব অপরাধ কমে আসবে হয়তো।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, রাজধানীসহ ঢাকা শহরে হঠাৎ করে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এসব ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে এবং মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। খুন-চুরি-ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় এর দায় এড়াতে পারে না সরকারি বাহিনী।
তিনি বলেন, এসব ঘটনার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। সেসব বিষয় চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে। এই বেপরোয়া খুন ছিনতাইকারী চক্রদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অভিযান চলমান রাখতে হবে।
কেএম/এমএমএ/