এলাকা নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্বই কাল হলো টিপুর!
জিসান-ফ্রিডম মানিকের দেশি গ্যাংদের খুুুঁজছে পুলিশ
রাজধানীর শাহজাহানপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। এ সময় দুর্বৃত্তরা এলোপাতাড়ি গুলি চালায়, যার কারণে রিকশায় থাকা বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতিও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
এ ঘটনায় আসামিদের ধরতে নড়েচড়ে বসেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। জানা যায়, এ হত্যার খুনিদের ধরতে অভিযানে নেমেছে র্যাব-পুলিশ-সিআইডি।
একটি তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশী নাগরিক দুবাইয়ে আত্মগোপন করা ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম জিসান আহমেদ মন্টি ওরফে জিসানের নির্দেশে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে খুন করা হয়েছে।
ওই সূত্রটি জানায়, জিসান বিদেশে বসে গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিকেরও যোগাযোগ রয়েছে। ফ্রিডম মানিক বর্তমানে ভারতে আত্মগোপন করে আছেন।
শনিবার (২৬ মার্চ) থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, টিপুর খুনিদের ধরতে দুষ্কৃতকারীদের হুমকি দেওয়া ফোন নম্বর নিয়ে এগোচ্ছে তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
একটি তথ্য বলছে, জিসান-ফ্রিডম মানিকের দেশী গ্যাংদের খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা মনে করছেন, ভাগাভাগি নিয়ে হয়তো টিপুকে হত্যা করা হয়েছে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের ৪ নং ডিভিশনের এক ঠিকাদার ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে টিপুর সঙ্গে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ নেতা খালেদ ও ঠিকাদার জি কে শামীম, এবং জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ও জিসানের ঝগড়া হয়।
এদিকে যুবলীগের একটি তথ্য জানায়, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টিপুর সঙ্গে অনেকের ঝগড়া হতো। কিন্তু ঝগড়া থেকে কি তাকে হত্যা করা হলো?
মতিঝিলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত মতিঝিল এলাকার টেন্ডারবাজি, মার্কেট নিয়ন্ত্রণ ও বাড়ি নির্মাণের চাঁদাবাজির পুরোটাই একা নিয়ন্ত্রণ করতেন টিপু।
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ নেতা খালেদ ও ঠিকাদার জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর একক নিয়ন্ত্রণ চলে আসে টিপুর হাতে।
জানা যায়, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, রেলওয়ে, কমলাপুর আইসিডি ডিপো, বিদ্যুৎ ভবন ও গণপূর্তের টেন্ডারবাজির একটি কমিশন বিদেশে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিককে দিতে হতো।
গত তিন বছর ধরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছে এসব টেন্ডারবাজির কোনো কমিশন দেওয়া হয়নি। এর জের ধরে টিপুর প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হয়। ঐ শক্তিশালী গ্রুপটিকে দিয়ে জিসান ও ফ্রিডম মানিকের টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয় টিপু। তবে, কে বা কারা টিপুকে হত্যা করেছে তা পুরোপুরি এখনো জানা যায়নি।
টিপু হত্যার ঘটনায় শুক্রবার তার স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি শাহজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা করেছেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ‘চার-পাঁচ দিন আগে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারী মোবাইল ফোনে টিপুকে হত্যার হুমকি দেয়। আমার স্বামী মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। তার মতিঝিল কাঁচাবাজার এলাকায় একটি রেস্টুরেন্ট আছে। ১০ বছর ধরে বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা কালীন দলীয় কোন্দল ছিল।
২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে গুলশান-১ নম্বরে শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিলকীকে (৪৩) সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনায় মিলকীর ছোট ভাই মেজর রাশেদুল হক খান মিলকীর দায়ের করা মামলায় জাহিদুল ইসলাম টিপু আসামি ছিলেন।
র্যাবের হাতে টিপু গ্রেপ্তার হয়ে কয়েক মাস জেলেও ছিলেন। পরবর্তী সময়ে র্যাবের দেওয়া চার্জশিটে টিপুর নাম বাদ দেওয়া হয়। মিলকী হত্যার পর টিপুর সঙ্গে যুবলীগের খালেদের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ২০১৬ সালে মতিঝিল এলাকায় যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবু খুন হয়। বোচা বাবুর বাবা টিপুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বোচা বাবু হত্যা মামলায় ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক, মিলকী হত্যা মামলার আসামি সুমনসহ ১০-১২ জন সবাই যুবলীগের নেতাকর্মী।
এই মামলায় ওমর ফারুকসহ সবাই চার্জশিটভুক্ত আসামি। সম্প্রতি একজন মন্ত্রীকে দিয়ে ওমর ফারুক ওই মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার সুপারিশ করান। কিন্তু বাদ সাধেন টিপু। বিষয়টি নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান-ফ্রিডম মানিক-মোল্লা মাসুদ-ইখতিয়ার গ্রুপের কাছে যায়। এই শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের পক্ষ থেকে টিপুর সঙ্গে একাধিকবার কথোপকথন হয়। টিপুকে অনুরোধ করা হয় যে প্রয়োজনে মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য বোচা বাবুর বাবাকে নির্দেশ দেন। টিপু সেই অনুরোধ রাখেননি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ২০১৩ সালে মতিঝিল এজিবি কলোনির একটি সংযোগ সড়কের দুই পাশে অবৈধভাবে নির্মাণ করা টিনশেড মার্কেটটি সিটি করপোরেশন ভেঙে দেয়। মার্কেটটি সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মির্জা খোকন দেখভাল করতেন।
তথ্য মতে জনা যায়, ২০১৯ সালের পর টিপু সেখানে মার্কেট স্থাপন করে প্রায় ১০০ দোকান ভাড়া দেন। ওই মার্কেটে টিপুর একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্না মাইক্রোবাস নিয়ে রেস্টুরেন্টের উদ্দেশে রওনা হন। মতিঝিল এজিবি কলোনিতে গ্র্যান্ড সুলতান নামে রেস্টুরেন্টে কাজ শেষে বাসায় যাওয়ার পথে রাত সোয়া ১০টার দিকে মানামা ভবনস্থ বাটার দোকানের সামনে মাইক্রোবাসটি থামে।
এ সময় রাস্তার বিপরীত পাশে মোটরসাইকেলে দুই জন অপেক্ষা করছিল। হেলমেট পরিহিত এক মোটরসাইকেল আরোহী থেমে থাকা মাইক্রোবাসের বামপাশে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। গুলিতে গাড়ির গ্লাস ভেঙে যায়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ সূত্র জানায়, নিহত টিপুর গলার ডান পাশে, বুকের বাম পাশে, নাভির নিচে, বাম কাঁধের ওপরে, পিঠের বাম পাশের মাঝামাঝি, পিঠের বাম পাশের কোমর বরাবর ও পিঠের ডান পাশের কোমরের ওপরসহ একাধিক স্থানে গুলির চিহ্ন রয়েছে। ময়না তদন্তকালে তার শরীরে সাতটি গুলির অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
এদিকে এলোপাথাড়ি গুলিতে আহত হন গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা কলেজছাত্রী প্রীতি। ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী তার শরীরে একটি গুলি ঢুকে অপরদিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। এতে সেও নিহত হন।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বেশকিছু মোটিভ পাওয়া গেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। র্যাব ছাড়াও অন্যান্য বাহিনীরা ও কাজ করছে।
জানতে চাইলে পুলিশের মতিঝিলি বিভাগের উপ-কমিশনার এমএ আহাদ বলেন, যে মোবাইল ফোন নম্বর থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল- সেটি বন্ধ আছে। আমরা যাচাই-বাছাই করছি।
তিনি বলেন, নিহত টিপুর স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি যে অভিযোগ করেছেন--সে গুলি নিয়ে পুলিশ কাজ করছে। তবে, তার স্ত্রী স্বামীকে হত্যার হুমকির বিষয়ে থানায় এ পর্যন্ত কোনো জিডি ও করেননি। তারপরও আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি।
জানতে চাইলে শাহজাহানপুর থানার ডিউটি অফিসার তমা বিশ্বাস বলেন, মামলার তদন্ত চলছে বলে জানতে পেরেছি। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান এবং ফ্রিডম মানিকের নেতৃত্বে খুন হয়েছে কি না সে বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন।
তথ্য বলছে, এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত রয়েছে তাদের সনাক্তের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে কিছু আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। যা নিয়ে কাজ করছে তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
জানা যায়, আসামিদের ধরতে পুলিশ, র্যাব, সিআইডি ও গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম এটি নিয়ে কাজ করছে। তা ছড়া, আ.লীগের নেতা টিপু ও শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় পেশাদার খুনি শুটারদের খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানতে চাইলে সিআইডি সদর দপ্তরের বিশেষ পুলিশ সুপার মর্যাদায় এক কর্মকর্তা ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ নেতা খালেদ ও ঠিকাদার জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের সাথে বিভিন্ন সংকট তৈরি হয় টিপুর। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা একক নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে সে।
তা ছাড়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিকেরও যোগাযোগ রয়েছে। ফ্রিডম মানিক বর্তমানে ভারতে আত্মগোপন আছে বলে জানতে পেরেছি। এই দুজনের সঙ্গে টিপুর সম্পর্ক ছিল বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। এবং তাদের সঙ্গে টিপুর বিভিন্ন সময় টেন্ডার ও টাকা পয়সা নিয়ে ঝগড়া হত। তদন্তের স্বার্থে তেমন কিছু বলা যাচ্ছে না। হয়তো মূল আসামিরা ধরা পড়লে বিস্তারিত তখন বলা যাবে।
সিআইডি সদর দপ্তরের আরেক পুলিশ সুপার বলেন, এটি একটি বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনার তদন্ত চলছে। টিপুকে ফোনে হত্যার হুমকি দেওয়া হতো সেই ফোন নম্বর নিয়ে কাজ চলছে। হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, সিআইডি ছাড়াও র্যাব, থানা পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একাধিক টিম কাজ করছে। আমি মনে করি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনার তথ্য উন্মোচন ও শুটারদের সনাক্ত করে আইনের হাতে সোপর্দ করা সম্ভব হবে।
কেএম/এমএমএ/