ঢাকার তিন ভবন বিস্ফোরণে ৪৪ মৃত্যুর দায় এড়িয়ে যাচ্ছে তিতাস
গত ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ২৬ জনের প্রাণহানি হয় । ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর মগবাজার, সিদ্দিকবাজার ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার তিনটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা মনে আছে নিশ্চই। এসব দূর্ঘটনায় ৪৪ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। তদন্তকারীদের তথ্য বলছে, গ্যাসের পাইপলাইনের ছিদ্র দিয়ে বের হওয়া গ্যাস জমে সব কটি বিস্ফোরণই ঘটে । আর এমনটি ঘটেছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে। কিন্তু এ–সংক্রান্ত মামলায় কাউকেই দায়ী করতে পারছে না পুলিশ। তারা তিনটি মামলারই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কোন ঘটনায় কে দায়ী, তা শনাক্ত করতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা তথ্য না দিয়ে নথি গায়েব হওয়ার অজুহাত দেখাচ্ছে।
পুলিশের এমন যুক্তি প্রসঙ্গে আইনজ্ঞরা বলছেন, অবহেলার কারণে এত বড় বড় দুর্ঘটনা এবং এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো না গেলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
মগবাজার ও সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনা দুটি তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। আর সায়েন্স ল্যাবরেটরির ঘটনা তদন্ত করছে নিউমার্কেট থানা-পুলিশ।
মগবাজার ও সিদ্দিকবাজারের মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়কারী টিমের প্রধান অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ব্যক্তির দায় নিরূপণ করতে না পারার কারণেই দুই মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির দায় নিরূপণ সম্ভব না হলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
গত ৭ মার্চ গুলিস্তানে বিআরটিসির বাস কাউন্টারের কাছে সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত সাততলা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ভবনের বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা অনেকটা ধসে যায়। বিস্ফোরণে মারা যান ২৬ জন। ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
সিটিটিসি তদন্তকালে ভবনের বেজমেন্টে তিতাসের একটি পরিত্যক্ত বাণিজ্যিক সংযোগের লাইন খুঁজে পায়। দুই যুগের বেশি সময় আগে বেজমেন্টে রান্নাঘর ছিল আর নিচতলায় ছিল রেস্তোঁরা। ২০০১ সালে গ্যাসের ওই লাইনটি রাইজার (গ্যাস সরবরাহের সংযোগস্থল) থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।তবে লাইন অপসারণ করা হয়নি। সিটিটিসি জানায়, পরিত্যক্ত ওই লাইনের ছিদ্র থেকে বেজমেন্টের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোনো একটি কক্ষের বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমে বিস্ফোরণ ঘটে। মাটি খুঁড়ে পরিত্যক্ত লাইনটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, লাইনে একটি বড় ছিদ্র রয়েছে। কাঠের টুকরা ঢুকিয়ে সেটি বন্ধ করা হয়েছিল, সেখানে মরিচা পড়ে ক্ষয় হয়ে গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এক্ষেত্রে তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দায়িত্বে অবহেলার পাশাপাশি অন্যায় করেছেন। প্রথমত, বাণিজ্যিক সংযোগ অপসারণ না করে সেখান থেকেই আবাসিক সংযোগ দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, কাঠের টুকরা দিয়ে গ্যাসের লাইনের ছিদ্র বন্ধ করেছেন। কিন্তু তিতাস কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিহ্নিত ও দায়দায়িত্ব নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিতাস কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা এ–সংক্রান্ত নথি খুঁজে পাচ্ছে না। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে তিতাসের মেট্রো ঢাকা বিপণন বিভাগের (দক্ষিণ) রাজস্ব ও বিক্রয় প্রকৌশল শাখাকে তিন মাস আগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাঁরা জবাব দেয়নি।
সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের দুই দিন আগে (৫ মার্চ, ২০২৩) সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার শিরিন ভবনের তৃতীয় তলায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ছয়জনের মৃত্যু হয়। এই মামলার তদন্ত শুরুর পর থানা-পুলিশ ওই ভবনের তৃতীয় তলায় তিতাস গ্যাসের সংযোগ পাইপ পেয়েছে। সেই সংযোগ পাইপের ছিদ্র দিয়ে তৃতীয় তলার কোনো একটি স্থানে গ্যাস জমে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
এর আগে ২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যার পর মগবাজারের ‘রাখি নীড়’ নামের ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়। সিটিটিসি সূত্র বলছে, ওই ভবনে আবাসিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় ২০১৪ সালে। এক বছরের মধ্যে ওই সংযোগ অপসারণ করার কথা। কিন্তু সেটি তিতাস করেনি। ওই লাইনে গ্যাসের সরবরাহ ছিল। লাইনে ছিদ্র থেকে ভবনের নিচতলায় থাকা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষে গ্যাস জমে, সেখান থেকেই বিস্ফোরণ ঘটে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, এ ঘটনায় তিতাসের অন্তত ২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কিন্তু ওই লাইন কেন অপসারণ করা হয়নি, কারা দায়িত্বে ছিলেন—এসব তথ্য বের করা যায়নি। পরিত্যক্ত সংযোগ অপসারণ না করার পেছনে তিতাসের ঢাকা মেট্রো বিপণন বিভাগের অভ্যন্তরীণ এক শাখা অন্য শাখার ওপর দায় চাপাচ্ছে।
তিতাস কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব ঘটনার ক্ষেত্রে তিতাসের কোনো দায় নেই। তিতাসের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, গ্রাহকের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির কারণেই বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ঘটেছে। কিন্তু তাঁদের অসহযোগিতার কারণে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
সংবাদ সূত্র: প্রথম আলো