বছরজুড়ে আলোচনায় ওয়াসা এমডি, মশার বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের যুদ্ধ
যুক্তরাষ্ট্রে বসে অফিস করা, ১৩ বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকা বেতন নেওয়াসহ ২০২২ সালের পুরোটা সময় আলোচনায় ছিলেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। অন্যদিকে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বছর পার করেছে মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তাকসিম এ খান ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে নিযোগ পান।
তারপর সরকার তার মেয়াদ ৫ দফা বাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনি ঢাকা ওয়াসার এমডি। ২০২৩ সালে তার মেয়াদ আবারও শেষ হচ্ছে।
তাকসিম এ খানের পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই তিনি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় পরিবারের সঙ্গে কাটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। এভাবে নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রে গেলেও ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেন না তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে বসেই অনলাইনে অফিস করেন। সর্বশেষ ২০২২ সালেও বরবারের মতোই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসে অফিস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার এবার তাকে সেই অনুমতি না দিয়ে ৬ সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করে।
গত বছর তাকসিম এ খান ছুটিতে থেকেও নথিপত্রে স্বাক্ষর করেন। অন্যদিকে, তার ছুটির সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এমডির দায়িত্ব পাওয়া ওয়াসার পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেমও নথিপত্রে স্বাক্ষর করেন। একসঙ্গে দুজন এমডির দায়িত্ব পালন নিয়ে সমালোচনা হয়। এ কারণে এবার ওয়াসা বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়, তাকসিম এ খান পূর্ণ ছুটিতে থাকবেন, ভার্চ্যুয়ালি কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া, তার ব্যাংক হিসাবও তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
এর বাইরে এ বছরই গত ১৩ বছরে বেতনবাবদ তাকসিম এ খান কত টাকা নিয়েছেন সেটা হাইকোর্ট ওয়াসা বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চান। পরে জানা গেল ওয়াসা এমডি ১৩ বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকা বেতন নিয়েছেন। আদালতে ঢাকা ওয়াসার দাখিল করা প্রতিবেদনেই ৬ কোটি টাকা বেতন নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব ঘটনায় পুরনো বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনায় আসে। জানা যায়, ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল টিআইবির এক প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তাকসিম ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিকে শতভাগ সুপেয় বলে দাবি করেন। বিষয়টি বিদায়ী বছরেও ব্যাপক আলোচিত হয়।
জনসাধারণের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও ওয়াসা এমডির এ মন্তব্যের সমালোচনা করেছিল। ২০১৯ সালে তিনি বুড়িগঙ্গা নদীতে কোনো পয়ঃনিষ্কাশন লাইন নেই বলে মন্তব্য করলে হাইকোর্ট তার মন্তব্যের সমালোচনা করেন।
২০১১ সালে দূষণ কমাতে বুড়িগঙ্গায় প্রবাহিত সব পয়ঃনিষ্কাশন লাইন বন্ধ করতে ওয়াসাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। এ নির্দেশনা অমান্য করায় এবং আদালতে মিথ্যা বলায় ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এসব বিষয়ও বিদায়ী বছরে নতুন করে আলোচনায় আসে।
মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বছর পার করল সিটি করপোরেশন এবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেরই ২০২২ সাল গেছে মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যদিও এই যুদ্ধে সিটি করপোরেশন কতটুকু জয়ী হয়েছে সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বছরজুড়েই মশার উপদ্রব ছিল। জুলাইয়ের আগে যুদ্ধ করতে হয়েছে কিউলেক্স মশার বিরুদ্ধে। মশা কখনোই নিয়ন্ত্রণে ছিল না।
জুলাইয়ে এলো ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার মৌসুম। ২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। কিন্তু মৃত্যুতে গত ২৩ বছরের মধ্যে বিদায়ী বছর রেকর্ড করেছে। এ বছর ২৮১ জন মারা গেছেন এবং আক্রান্ত হয়েছেন ৬২ হাজার ১৮৯ জন।
অবস্থা এমন যে খোদ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই বলাবলি করেন মশা নিধন অভিযান ফলপ্রসূ হলে এডিসের বিস্তার এত মারাত্মক পর্যায়ে যেত না। তার মানে মশা নিধনে গলদ রয়েছে সিটি করপোরেশনের। খোদ সরকারের আরেকটি দপ্তর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই বলছে, মশা নিধনে গলদ আছে বলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ডেঙ্গু নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ অভিযোগ করেন।
বছরজুড়েই মশা নিধনে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, চিরুণি অভিযান প্রভৃতি বাহারী নামে কার্যক্রম চালিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) তো মশক নিধনে ড্রোন পর্যন্ত ব্যবহার করেছে। কিন্তু নগরবাসীর অভিযোগ, এত মহাযজ্ঞে মশা মরেছে খুব সামান্যই। তার প্রমাণ ডেঙ্গুতে মৃত্যুর রেকর্ড। মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আরেকটা অস্ত্র ছিল বছরজুড়েই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা। দুই সিটি করপোরেশনই শুধু মশা নিধনের উদ্দেশেই বছরজুড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। এসব আদালত থেকে বিভিন্ন ভবন মালিককে জরিমানা করা হয়েছে।
এই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিষয়টি নিয়েও সমালোচনায় সোচ্চার ছিল নগরবাসী। তাদের অভিযোগ, মশক নিধন বাবদ দুই সিটি করপোরেশন ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেলেও তাদের কাজ না করে তারা উল্টো নগরবাসীকে জরিমানা করছে।
আরইউ/এমএমএ/