অভিযুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কার চান ফুলপরী
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে (ইবি) ছাত্রলীগ নেত্রী ও তার সহযোগীদের দ্বারা ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কার চান ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন। কারণ বুধবার (১ মার্চ) দেওয়া হাইকোর্টের আদেশে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি তিনি।
হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ফুলপরী বলেন, ‘আমার ওপর তারা যে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাতে অস্থায়ী বহিষ্কার নয় আমি তাদের স্থায়ী বহিষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিল চাই। তা না হলে ক্যাম্পাসে ফিরলে আমাকে মেরে ফেলার আশঙ্কা থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি হল পরিবর্তন করতে পারি। সেক্ষেত্রে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল বা খালেদা জিয়া যেকোনো একটিতে উঠতে পারি।’
ক্যাম্পাসে কবে ফিরতে চান জানতে চাইলে ফুলপরী বলেন, ‘আমি পরিপূর্ণ নিরাপত্তা পেলে এবং স্যাররা যখন জানাবেন তখনই ক্যাম্পাসে ফিরে যাব।’
এ প্রসঙ্গে ফুলপরীর বাবা আতাউর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করতে পারবে কি-না এ বিষয়ে আমরা সন্দিহান। এ ধরনের অপরাধীরা ক্যাম্পাসে আর না থাকুক আমরা সেটাই চাই।’
এদিকে এ ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবিতে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফুলপরী খাতুন। এ বিষয়টি নিজেই নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম (সিরাজ প্রামানিক) বলেন, আজ (বুধবার) ফুলপরী মামলা করেননি। অসুস্থতার জন্য আসেনি। মামলার সব কিছু রেডি আছে। ফুলপরী এলে মামলার ফাইল হবে।'
অন্যদিকে সংগঠনবিরোধী, শৃঙ্খলা পরিপন্থী, অপরাধমূলক ও সংগঠনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এমন কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই পাঁচ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
বুধবার (১ মার্চ) সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান।
তিনি বলেন, 'আমাদের উৎসগুলো থেকে তথ্যের ভিত্তিতে বহিষ্কার করেছি। সকলের সংশ্লিষ্টতা আছে এটা নিশ্চিত। এখন অপরাধ কতটুকু এটাতো বিবেচ্য বিষয়। এখানে তাদের ভুল বা অন্যায় যেটাই হোক, তার গভীরতার ভিত্তিতে বহিষ্কারাদেশ কার্যকর হবে। এটা স্থায়ীও হতে পারে আবার অস্থায়ীও হতে পারে।'
অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইকোর্টের বহিষ্কারাদেশ ও সংগঠন থেকেও বহিষ্কারের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও।
শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ইবিতে যে র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটেছে এটা খুবই নেক্কারজনক। ছাত্রলীগে কোনো অপরাধীর স্থান হবে না। সেই অপরাধ আমি বা অন্য কেউ যেই করুক না কেন। ব্যক্তির দায় কখনও সংগঠন নেবে না। এটার মাধ্যমে ভবিষ্যতে যারা অপরাধ করবে তাদের জন্যও একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল।’
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় আমরা যে তদন্ত কমিটি করেছিলাম সেই তদন্তের রিপোর্ট কেন্দ্রে প্রেরণ করেছিলাম। এই সংগঠনের কোনো দুষ্কৃতিকারী বা কেউ অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাকে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। তারই ফলস্বরূপ কেন্দ্র তাদের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ নিয়েছে আমরা তার স্বাগত জানাই।
তবে অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে অস্থায়ী বহিষ্কারে হতাশা প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সাদিয়া মাহমুদ মিম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা অপরাধীদের যে ধরনের শাস্তির আশা করেছিলাম তা দেখতে পাইনি। আমরা চাই তাদের স্থায়ী বহিষ্কারের মাধ্যমে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হোক। যাতে ভবিষ্যতে কেউ যেন আর এ ধরনের কাজ করার সাহস না পায়।’
অর্প নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, অভিযুক্তদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
অভিযুক্তদের বহিষ্কারের বিষয়ে শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানা গেছে। আরও জানা গেছে, এতে সভাপতিত্ব করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, অভিযুক্ত ছাত্রীদের বিষয়ে হাইকোর্ট থেকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত এসেছে। আমরা ইতিমধ্যে তাদেরকে হল থেকে বহিষ্কার করেছি। তারা সবাই হল ছেড়ে দিয়েছেন। আগামী শনিবার শৃঙ্খলা কমিটির মিটিং রয়েছে। সেখানে বিস্তারিত আলোচনা ও আদালতের নির্দেশনা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর নিরাপত্তা ও হলে উঠার বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি যেন নির্বিঘ্নে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। তার সর্বোচ্চ নিরাপত্তার নিশ্চিতের বিষয়ে রেজিস্ট্রার ও ছাত্র উপদেষ্টাকে বলে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সে যে হলে থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবে সে হলেই থাকবে।
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় ব্যর্থতাসহ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে হাইকোর্টের মতামত ও নির্দেশনা সম্পর্কে উপ-উপাচার্য বলেন, হাইকোর্টের পর্যালোচনার হার্ডকপি আমরা এখনও পাইনি। ওটা পেলে দেখব আমাদের কোন কোন জায়গায় ঘাটতি,গাফিলতি রয়েছে, কোন জায়গাগুলোতে আমরা এখনও ভালোভাবে এড্রেস করতে পারিনি। সেগুলো পর্যালোচনায় নিয়ে আমাদের নিজেদের যদি দায় থাকে অবশ্যই মাথা পেতে নেব। এছাড়া মহামান্য হাইকোর্ট যদি ভবিষ্যতের জন্য কোনো নির্দেশনা দেন তাহলে সেই অনুযায়ী চলার চেষ্টা করব এবং আমাদের কোনও সীমাবদ্ধতা থাকলে সেটাও সংশোধনের চেষ্টা করব।
স্থায়ী বহিষ্কার করার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিধিবিধান আছে সেই বিধিবিধান মেনেই কোন কোন ধারায়, কোন পর্যায়ে কার কতটুকু অপরাধ তা নির্ধারণ করেছেন তদন্ত কমিটি এবং মহামান্য হাইকোর্ট কি নির্দেশনা দিয়েছেন সবকিছু পর্যালোচনা করে যার পক্ষে যতটুকু সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার সেটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিবে।
উল্লেখ্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ওঠার পর ছাত্রলীগ নেত্রীদের র্যাগিংয়ের শিকার হন ফুলপরী। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ফুলপরীকে বিবস্ত্র করে রাতভর শারীরীক নির্যাতন এবং ভিডিও ধারণ করে ইবি ছাত্রলীগ সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগিরা। পরদিন প্রাণভয়ে পালিয়ে বাড়ি চলে আসেন ফুলপরী। পরে দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
পরে হল প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা সাপেক্ষে সোমবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) পাঁচ অভিযুক্তের আবাসিকতা ও দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল সংযুক্তি বাতিল করেন হল প্রভোস্ট। এ সময় পহেলা মার্চ (বুধবার) বেলা ১২টার মধ্যে তাদেরকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে নির্ধারিত সময়ের আগেই মঙ্গলবার দিনের বিভিন্ন সময়ে হল ত্যাগ করেন তারা।
এসআইএইচ