ক্যাম্পাসে যেমন কাটল নবীনদের প্রথম দিন
উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে শিক্ষার্থীরা তাদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য একটু একটু করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে। স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন তারা। কত রাত না ঘুমিয়ে পার করে দেন শুধু স্বপ্নকে ছোঁয়ার জন্য। আসন স্বল্পতার কারণে অনেকে স্বপ্নকে ছুঁতে পারে আর অনেকের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
যারা সফল হন তাদের জন্য ক্যাম্পাস জীবনের প্রথম দিনটি থাকে চিরস্মরণীয় হয়ে। ভীষণ আবেগ নিয়ে প্রথম দিনে ক্যাম্পাসে আসেন নবীন শিক্ষার্থীরা। প্রথম দিনটিকে ঘিরে নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। তেমনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) কয়েকজন নবীন শিক্ষার্থী জানালেন নিজেদের ক্যাম্পাস জীবনের প্রথম দিনের অনুভূতির কথা।
শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আহমেদ সামিয়া বলেন, শত প্রত্যাশা আর স্বপ্ন বোনা সেই কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হয়ে যেদিন প্রথম পদচারণ করলাম, সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনের অনুভূতি ছিল এক আকাশ ছোঁয়া সমপরিমাণ আনন্দের। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার প্রথম দিন সকাল সকাল ক্যাম্পাসের লাল বাসে করে ক'জন ব্যাচমেটের সঙ্গে চলে আসলাম বহুল প্রতীক্ষিত ক্যাম্পাসে। বাস থেকে নেমেই এক পলকে পুরো ক্যাম্পাসটা চোখের আয়ত্বে আনলাম, বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে আমি আমার কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার পাবলিকিয়ানদের মাঝে একজন পাবলিকিয়ান হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি।
তিনি বলেন, এ যেন এক স্বপ্ন ছিল। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ব্যাচমেট বন্ধু পেছন থেকে ডাকল শুনতেই পেলাম না। তারপর আমরা ক'জন আমাদের শিক্ষা প্রশাসন ডিপার্টমেন্টের দিকে রওনা দিলাম। যাত্রাপথে আমার ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যগুলো যেমন- ক্যাম্পাসের বিশাল আয়তনের খোলা মাঠ, আড্ডা দেওয়া বা অবসর সময় কাটানোর জন্য 'শান্তিনিকেতন', কেন্দ্রীয় মসজিদ, চারদিকের সবুজের ছায়াঘেরা দৃশ্যগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করলাম। তারপর চেয়ারম্যান স্যারের নির্দেশে ক্লাসরুমে গিয়ে পৌঁছালাম সবাই। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে আগত ব্যাচমেটদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এরপর শামসুল আরেফিন স্যারের ক্লাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ১ম ক্লাস শুরু করলাম। তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
তিনি আরও বলেন, ক্লাসের শেষে আমাদের সিনিয়র ভাইয়া এবং আপুদের সঙ্গে পরিচিত হই। প্রথমে অনেক ভয় এবং আতঙ্কিত ছিলাম কারণ নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, সব নতুন মুখ, মানিয়ে নিতে পারব কি না। কিন্তু না! আমাদের ভাইয়া আপুদের কথা শুনে মনে হলো ভয়ের কিছুই নেই। তারা যথেষ্ট ভালো এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। আমাদেরকে অনেক দ্রুতই তারা ছোট ভাই-বোনের মতো আপন করে নিয়েছে। তারপর শান্তিনিকেতনে ভাইয়া আপুদের সঙ্গে চা, আড্ডা দিয়েছি। পরে নোবিপ্রবির সেই লাল বাসে করে বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় যে একটি পরিবার থেকে কম নয় বরং বেশি, সেটি আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং সিনিয়র ভাইয়া-আপুদের স্নেহ ও আন্তরিকতা না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। এখন তাদের থেকেই পথনির্দেশনা নিয়ে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে চাই, শিখতে চাই কীভাবে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করতে হবে। সবশেষে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন জীবনের এক স্মৃতিমাখা দিন, যা সারা জীবন এক অনন্য অনুভূতি হয়ে গচ্ছিত থাকবে।
সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া আলম ইশা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটি ছিল এক নতুন জীবনের সূচনালগ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিনটার আনন্দ আকাশ ছোঁয়ার মতো ছিল আমার কাছে। শত প্রত্যাশা আর স্বপ্ন বোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেখানকার একজন শিক্ষার্থী হয়ে যেদিন প্রথম পদাচারণ করলাম, সে এক দারুণ অনুভূতি ছিল। রীতিমতো প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী যুদ্ধক্ষেত্র পাড়ি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ হয়ে উঠে। আর তা যদি হয় নিজের স্বপ্নে লালিত প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় 'নোবিপ্রবি' তাহলে তা আনন্দের এক অসীম মাত্রা যুক্ত করে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনে আমিও সব নবীনের মতো নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হিসেবে আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম। অবশ্য এই আনন্দের সঙ্গে কিছুটা ভয়ের মিশ্রণও ছিল। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ। মনে হচ্ছিল পুকুর থেকে হয়তো মহাসমুদ্রে পড়ে গেলাম। কিন্তু এ ভয়ের অনেকটাই অবসান ঘটে গেল যখন নিজের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস রুমে যাই এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অপরিচিত মুখগুলো আপন করে নিচ্ছিল আমায়।
তিনি আরও বলেন, প্রথম দিনে শিক্ষকদের সঙ্গে অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে খুবই সুন্দর। আমাদের উপাচার্য স্যার নবীনদেরকে একজন প্রকৃত ভালো মানুষ হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। অনেককেই আবার প্রথম বছর হেলায় না কাটানোর কথা বলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতিনীতি তুলে ধরেন। বিশ্ববিদ্যালয় যে একটি পরিবার থেকে কম নয় বরং বেশি, সেটা বুঝতে পারি যখন বড় ভাইয়া আপুদের সঙ্গে আলাপ হয়। পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটি আমার কাছে ছিল খুবই আনন্দের যা এক নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার করে। এই দিনটি আমার এক নতুন জীবনের সূচনা করে।
শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী সুবর্ণা ফেরদৌস জাহান বলেন, এক যুগ আমরা পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছেছি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকমণ্ডলী ও বড় ভাইয়া এবং আপুদের অতিথি পরায়ণতা যেন পরিবারের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন নিয়ে সবারই অনেক প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা থাকে। এই দিনটিতে আমি অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আমি একটু কষ্টেও ছিলাম। জীবনে এই প্রথম আমি আমার মায়ের আদর গায়ে না মেখে ঘর থেকে বাইরে যাব।
তিনি বলেন, দিনটি ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি। সকালে উঠেই নামাজ পড়েছিলাম। তারপর যেহেতু মা নেই তাই আমাকেই রান্না করতে হয়েছে। তারপর তৈরি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। এরপর আমার বিভাগে গিয়ে শ্রেণিকক্ষে বসেছিলাম। তখন শ্রেণিকক্ষে সবেমাত্র কিছু সংখ্যক বন্ধু-বান্ধবী এসেছিল। আর আমাদের সবার ক্লাসরুম চিনতে ভুল হয়েছিল। আমাদের আইসিটি ক্লাস ছিল তাই ক্লাসটি ল্যাব রুমে হয়েছিল। যখনি জানতে পেরেছি ক্লাস রুমটা ল্যাবরুমে হবে তখনই আমরা সবাই মিলে ৪১২নং রুমে চলে যাই। কিছুক্ষণ পর বিপ্লব মল্লিক স্যার ও সিয়াম স্যার এসে আমাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। স্যারদের ক্লাসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল আমরা যেন তাদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি এবং তারা সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে।
তিনি আরও বলেন, আমি স্যারদেরকে দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম প্রথমটি ছিল, 'আমাদের প্রত্যেকের জীবনে অনেক হতাশা আছে। জীবনে কী এমন হতাশা আছে যার জন্য কষ্ট লাগে?' দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল, 'আমি যেহেতু শিক্ষা বিভাগে অধ্যয়নরত আছি তাহলে আমি কি এই বিভাগে পড়ে শিক্ষামন্ত্রী হতে পারব?' দুটি প্রশ্নের জন্যই আমি করতালি পেয়েছি যেটা আমাকে আমার জীবনের স্বপ্নপূরণের জন্য অনেক সাহায্য করবে। এরপর আমাদের দ্বিতীয় ক্লাস বিপুল স্যার নিয়েছিল। তিনি আমাদেরকে অধ্যায়নরত বিভাগ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। যেখান থেকে আমি আমার ক্যারিয়ার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি এবং আমার অনেক বেশি ভালো লেগেছে। এভাবে আমাদের প্রথম দিনের দুটি ক্লাস সমাপ্ত হয়েছিল। তারপর আমরা বড় ভাইয়া আপুদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছি। তাদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো আমার জীবনে সব সময় স্মৃতি হয়ে থাকবে এবং আমি কখনই ভুলব না। দিন শেষে আমার জীবনে এটি সেরা মুহূর্ত ছিল।
এসজি