রাতভর শিক্ষার্থীকে নির্যাতন, ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ছাত্রী হলে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেছেন প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তার অনুসারীরা দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
নির্যাতনের সময় তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল এবং এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই ছাত্রী মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, হলের প্রভোস্ট ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট শামসুল হক। এদিকে অভিযুক্ত ওই ছাত্রলীগ নেত্রীও প্রক্টর, ছাত্র-উপদেষ্টা ও হল প্রভোস্ট বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
সানজিদা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অপর অভিযুক্ত তাবাসসুম ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। ভুক্তভোগী ছাত্রীও একই বিভাগের।
লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ছাত্রী জানান, ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এ জন্য তিনি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের এক আবাসিক ছাত্রীর কাছে অতিথি হিসেবে থাকেন। বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চান, কারা দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে থাকেন। এ সময় ওই ছাত্রী হাত তোলেন। হলে ওঠার বিষয়টি আগে তাবাসসুমকে না জানানোয় চটে যান তিনি। এর পর তাকে হলের কক্ষে (প্রজাপতি-২) দেখা করতে বলেন। তবে অসুস্থ থাকায় দেখা করেননি তিনি। ১১ ফেব্রুয়ারি ক্লাসে গেলে তাকে বকাঝকা করেন তাবাসসুম।
ওই ছাত্রীর অভিযোগ, এ ঘটনার জেরে ১২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে হলের গণরুমে (দোয়েল) তাকে ডেকে নেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী। সেখানে পাঁচ থেকে ছয়জনের একটি দল তাকে দিবাগত রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নানাভাবে নির্যাতন করেন। তিনি বলেন, আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল আর এর ফাঁকে ফাঁকে চালাচ্ছিল শারীরিক নির্যাতন। কিল, ঘুষি, থাপ্পড় কোনোটাই বাদ রাখেনি। কাপড় আটকানোর আলপিন দিয়ে পায়ের ঊরুতে ফুটাচ্ছিল।
ভুক্তভোগী ছাত্রী অভিযোগ করেন, নির্যাতনের সময় আরেক ছাত্রী মোবাইল ফোন দিয়ে ভিডিওধারণ করেন। একপর্যায়ে বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণ করা হয়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি পা ধরে ক্ষমা চাইলেও তারা কোনো কথা শোনেননি। গণরুমে এ সময় উপস্থিত সাধারণ ছাত্রীরাও কোনো কথা বলেননি।
ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণের সময় হুমকি দেওয়া হয়। বলা হয় এই কথা কাউকে জানালে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এমনকি প্রভোস্টের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিষয় লিখে দিয়ে আমাকে বলেছেন, হাসবি আর এগুলা বলবি। সব তারা ভিডিও করে রেখেছে। আপুরা মারার সময় বলছিল, মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে।
রাতের কথা কাউকে জানালে ওই ছাত্রীরা তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, এ কথা কাউকে বললে হল থেকে বের করে দেবে বলে শাসায়। এই কথা বাইরে গেলে ভিডিও ভাইরাল করে দেবে। তারা বলে, তুই হলের প্রভোস্ট স্যারকে বলবি, সব আমার দোষ, এই হলে থাকব না। এসব বলে হল থেকে একেবারে চলে যাবি। এই কথা ১৪ তারিখ বলবি।
ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, অনেকবার ক্ষমা চেয়েছি, কেউ কোনো কথা শোনেনি। রাত সাড়ে ৩টার পর তাঁরা চলে যায়। আমি গণরুমেই ছিলাম। এর পর ১৩ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) সকাল নয়টার দিকে ক্যাম্পাসের সামনে থেকে বাসে উঠে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। আমার শরীর ব্যথা। জ্বর অনুভব করছি। ঠিকমতো খেতে পারছি না। গালের ভেতর কেটে গেছে। সার্বিক বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুরে আমি প্রক্টর, ছাত্র-উপদেষ্টা ও প্রভোস্টের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। আমি এ ঘটনার বিচার চাই। যারা জড়িত, প্রত্যেকের শাস্তি চাই।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী বলেন, অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। ওই মেয়ে মিথ্যা বলছে। হয়তো এক কুচক্রী মহল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তার ব্যাপারে প্রমাণ দিয়েছি। প্রভোস্ট, ছাত্র উপদেষ্টা ও প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
এদিকে সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাত ১২ টার পরে হলের অভ্যন্তরে বিক্ষোভ করেছে অন্তরার অনুসারী। ভুক্তভোগী ফুলপরীর বহিষ্কারের দাবিতে ও সাংবাদিকদের নিউজের প্রেক্ষিতে তারা এ বিক্ষোভে অংশ নেয়। পরে রাত ২ টার দিকে তারা হলের মেইন গেটে খুলে ভিসির বাংলোর সামনে অবস্থান নেয়। ভোর চারটা পর্যন্ত অবস্থান শেষে পরে প্রক্টরিয়াল বডি এসে তাদের সঙ্গে উপাচার্য বসবেন এবং সমস্যার সমাধান করবেন এমন আশ্বাসে তারা আন্দোলন তুলে নেয়।
পরে মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০ টায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে অন্তরার নেতৃত্বে ৬-৭ জন নেতাকর্মী আলোচনায় বসেন। ইবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ঘটনাটি শুনেছি। বিষয়টি খোঁজখবর নেওয়া হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, উভয়ের লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে এবিষয়ে হল থেকে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ছাত্র উপদেষ্টা প্রফেসর ড. শেলীনা নাসরিন বলেন, আমরা র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে বরাবরই জিরো টলারেন্স। ওই ছাত্রীর বিষয়টি শুনেছি। উভয়ের লিখিত অভিযোগও হাতে পেয়েছি। বিষয়টির সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, বিষয়টি জেনেছি-শুনেছি। উভয় পক্ষের কথা শুনে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, র্যাগিংয়ের বিষয়টি আমি শুনেছি। র্যাগিং তো একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও র্যাগিং ছিলো না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়গুলো অ্যালাউ করে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে বিষয়টি বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এএজেড