ববিতে ৬ বছরেও হচ্ছে না অনার্স ফাইনাল
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) তীব্র সেশনজটের কারণে ৬ বছরেও অনার্স ফাইনালে বসতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। স্নাতক শ্রেণী শেষ না হওয়ায় ৪৫তম বিসিএসে আবেদনসহ সরকারি চাকরি থেকে পিছিয়ে পড়ছেন ১৮টি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এই দুশ্চিন্তা ভর করছে তাদের অভিভাবকদের উপর।
বিশ্ববিদ্যালয়সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট ৬টি অনুষদে ২৪টি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্য ১৮টি বিভাগেই রয়েছে সেশনজট। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ১৮টি বিভাগের এক হাজারের অধিক শিক্ষার্থী সেশনজটে পড়েছেন। এর মধ্য কয়েকটি বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা চলমান। ১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের কয়েকটি বিভাগের ৭ম সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে জানুয়ারিতে পরীক্ষা শেষ হবে।
শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা যায়, বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ৬টি বিভাগের ৫টি তেই সেশনজট রয়েছে। সিএসই বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ৬মাসের জট রয়েছে। গণিত, রসায়ন ও ভূতত্ত্ব খনিবিদ্যা বিভাগের এক সেমিস্টার করে জট রয়েছে। পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলমান যা জানুয়ারিতে শেষ হবে। জীব বিজ্ঞান অনুষদের ৪টি বিভাগের ২টিতে জট রয়েছে। প্রাণ রসায়ন ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলমান।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ৪টি বিভাগের প্রত্যেকটিতে জট রয়েছে। ৪টি বিভাগের ১টি বিভাগেরও ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থীরা অনার্স শেষ করতে পারেননি। ম্যনেজমেন্ট বিভাগের ৮ম সেমিস্টারের রুটিন দিয়েছে যার পরীক্ষা শুরু হবে জানুয়ারি থেকে। মার্কেটিং ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীরা এখনো ৬ষ্ট সেমিস্টার শেষ করতে পারেননি। ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীরাও ৩য় বর্ষে পদার্পণ করতে পারেনি।
কোস্টাল ও ডিজিস্টার ম্যানেজমেন্ট, প্রাণরসায়ন ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগেও রয়েছে সেশনজট। এই বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ২১ সালে অনার্স শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৪ সালেও অনার্স শেষ হবে কিনা ভরসা পাচ্ছি না। অন্যদিকে কাছের মানুষও অপেক্ষায় আছে। সময় চলে যাচ্ছে। এখন মানসিক চাপ, আর্থিক এবং ডিপ্রেশনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেশনজট। ইংরেজি বিভাগের ১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইমদাদুল ইসলাম দূরন্ত বলেন, সেশনজটের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে পূর্ববর্তি সেমিস্টারের রেজাল্ট দেরিতে প্রকাশিত হওয়া।
অর্থনীতি বিভাগের ১৭-১৮ বর্ষের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সেশনজট এর মূল কারণ শিক্ষক সংকট, ক্লাস রুম সংকট, যেখানে ব্যাচ থাকার কথা ৫টি সেখানে ব্যাচ হয়ে গেছে ৬ টা ৭ টা ব্যাচ আমাদের ডিপ্টে একটা ক্লাস রুম। এছাড়াও পরীক্ষার ফল প্রকাশে ৭থেকে ৮ মাস সময় লাগে। ৫ম সেমিস্টারের রেজাল্ট প্রায় ৮ মাস পরে প্রকাশ হয়েছে। মানসিকভাবে অনেক সমস্যায় আছি সেশনজট এর কারণে, একটা অনিশ্চিত জীবন পার করছি। বাবা-মা অসুস্থ তাকিয়ে আছে আমি কিছু করবো, কিন্তু আমি নিজেই হতাশায় আছি কবে অনার্স শেষ হবে।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ৫টি বিভাগের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ছাড়া বাকি ৪টি বিভাগেই সেশনজট রয়েছে। অর্থনীতি বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থীদের ৭ম সেমিস্টার এখনো শেষ করতে পারেনি। লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা অনার্স শেষ করতে পারেননি। ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীরাও ৬ মাসের জটে রয়েছে। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা অনার্স শেষ করতে পারেনি। অন্যদিকে কলা ও মানবিক অনুষদের ৪টি বিভাগের ২টিতে জট রয়েছে। ইংরেজি ও বাংলা বিভাগের ১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের অনার্স শেষ হয়নি বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষার্থীরা।
মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আশিক বলেন, সেশনজটের কারনে আমাদের পড়াশোনায় মনযোগ দিতে পারছি না। পরিবার থেকেও নানান চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠীদের অনার্স শেষ হয়েছে অনেকে চাকরিও করছে সেখানে আমরা এখনো অনার্স শেষ করতে পারলাম না। লোকপ্রশাসন বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্লাস শুরু করেছি এখনো ২য় বর্ষ শেষ করতে পারিনি। তিন বছরে মাত্র ৩টা সেমিস্টার শেষ হয়েছে।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান মো. ইমরান হোসেন বলেন, আমাদের সবার প্রচেষ্টা ছিল সময়মত ক্লাস পরীক্ষা নিয়ে নেওয়া যেন সেশনজট না থাকে। সেজনজট শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার আগ্রহ কমিয়ে দেয়। বিভাগের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের আন্তরিক সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় সময়মত আমরা ক্লাস পরীক্ষা শেষ করতে পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এ বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ জানান, আমি ডিন হিসেবে কিছুদিন আগে দায়িত্ব পেয়েছি। করোনার সময় থেকে মূলত জটটি শুরু হয়েছে এই জটগুলো নিরসনে ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। আশাকরি আগামী ৬মাস পর থেকে সেশনজট কমতে শুরু করবে।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সহযোগী অধ্যাপক দিল আফরোজ খানম বলেন, সেশনজট নিরসনে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি ইতোমধ্যে আমরা বিভাগগুলোর সাথে বসে আলোচনা করেছি। যে সমস্ত বিভাগুলোতে জট থাকবে না তাদেরকে ডিন অফিস থেকে পুরস্কৃত করা হবে। আমাদের একাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরি করা শেষ পরবর্তী সেশনগুলো আশা রাখছি আর জটে পড়বে না।
বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন সহযোগী অধ্যাপক শফিকুল আলম এ বিষয়ে জানান, আমাদের সেশনজটের পিছনে কিছু সংকট রয়েছে যেমন ল্যাব সংকট, শিক্ষক সংকট অনেক সময় দেখা যায় পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে বিভিন্ন কারণে দেরি হয়। এর কারণে পরবর্তী সেমিস্টারের পরীক্ষা নিতে পারে না। উক্ত সংকট নিরসনে আমরা কাজ শুরু করেছি প্রশাসনও আমাদের কাজে যথেষ্ট সাহায্য করছে আশা রাখছি আগামীতে সেশনজট কমে আসবে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ড. মো. বদরুজ্জামান ভূইঞা বলেন, আমরা সেশনজট নিরসনে ইতিমধ্যেই কিছু শিক্ষার্থীবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি এবং খুব শীঘ্রই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা সেগুলো বাস্তবায়ন করবো। শিক্ষার্থীরা এই পরিকল্পনার সুফল অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে পারবে। এ বিষয়ে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ করেন নি উপাচার্য।
এএজেড