'আইনজীবী হয়ে বাবার মৃত্যুর বিচার করতে চাই'
পায়ে চলতে না পারলেও নিজের স্বপ্ন পূরণে ছুটে চলছে মো. রিফাত রহমান। শুধু পায়ে নয় ডান হাত দিয়েও তেমন কোন কাজই করতে পারে না সে। সেজন্য বাম হাতেই সকল কাজ করতে হয়। একাই চলতে ফিরতে ও কথা বলার জড়তার জন্য শুনতে হয় সমাজের নানা কটু কথা। এমন শারীরিক সমস্যা নিয়ে তার পড়ালেখা করা প্রায় অনিশ্চিতই ছিলো। কিন্তু নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে ও মায়ের সর্বাত্মক পাশে থাকা সকল বাঁধা আজ পর্যন্ত তার কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সকল বাঁধা, অন্ধকার জয় করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে মো. রিফাত রহমান।
রিফাতের রহমানের সফলতার গল্পটি শোনা হয় তার নিজের মুখেই। তিনি বলেন, আমি যখন বুঝতে পারি আমার অনেক বড় শারীরিক সমস্যা রয়েছে, লোকেও বলতো আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। একদিন রাতে আমার সামনেই একজন বলে উঠলো, তুমি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে কি করবে, তোমার বড় ভাই হলে কিছু একটা হতো। আমি কিছু করতে পারবে না এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই কিছু করার জন্য পড়াশোনা করছি। রিফাতের বাড়ি চুয়াডাঙ্গার পিটিআই মোড়ে।
বাড়িতে তার মা মোছা. রহিমা খাতুন আছেন, বড় ভাই মো. জুবায়ের রহমান আছেন এবং বাবা মো. সাইদুর রহমান ২০১৯ সালে এক দুর্ঘটনায় মারা যান। বড় ভাই ফ্রিল্যান্সিং করে। জন্মের পর সে প্রায় তিন বছর কথা বলতে পারেনি। কিন্তু তার মা হাল ছেড়ে দেয়নি। তিনি রিফাতের কথা বলার জন্য যা করার সব কিছু করেন। এখন সে কথা বলতে পারে কিন্তু তারপরও সমস্যা হয়। তাই প্রায়ই সময় একাই কথার জড়তা কাটাতে কথা বলার অনুশীলন করে। আজকেও জুবেরী মাঠে অনুশীলন করে বাসায় যাবে বলে জানায় রিফাত।
তার রাজশাহীর বর্তমান অবস্থানের বিষয় বলেন, এই প্রথম বাড়ির বাহিরে আছি প্রায় দুই মাস। এখানে রাজশাহী ধরমপুর এলাকায় মা-সহ থাকি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকটা দূর হওয়ায় আমার যাওয়া আসা সমস্যা হয়। অন্যদিকে রাস্তাটাও অনেক দুর্ঘটনা প্রবণ। বাবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় তার মৃত্যুর পর তার পেনশন দিয়েই আমাদের সংসার চলছে। সেই টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা আমাদের জন্য কষ্ট হয়।
দুই সপ্তাহ হলো আমি বৈদ্যুতিক হুইলচেয়ার ব্যবহার করছি। তাতে কিছুটা উপকার হচ্ছে। কিন্তু একাডেমিক ভবনগুলোতে একাই যেতে পারি না কারণ প্রবেশ সিঁড়ি গুলো হুইলচেয়ার উঠার মতো চওড়া নয়। তাই ক্লাস করতে আসার সময় বন্ধুদের মাধ্যমে সিঁড়ি উপরে উঠি। বন্ধুরাই আমাকে ক্লাসে যেতে সাহায্য করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি হলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন তাহলে আমার জন্য খুব উপকার হয়।
রিফাত প্রথম যখন স্কুলে ভর্তি হতে যায় ভেবেছিলো তাকে হয়তো ভর্তি নিবে না। কিন্তু দ্বীপশিখা প্রি-ক্যাডেট স্কুল তাকে ভর্তি নেয়। আর সেখানে থেকে তার পড়াশোনা শুরু। এজন্য সে ওই স্কুলকে ধন্যবাদ জানায়। কারণ শুরুটা তার ওখান থেকে না হলে এতদূর আসা কঠিনই ছিলো। সে তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ফলাফলের দিক দিয়ে থাকে সবার থেকে এগিয়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে ৬০০ এর মধ্যে ৫৭৩ নম্বর পেয়ে বৃত্তি পায়।
নীলমণিগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে দশম এবং চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে সাফল্যের সাথে উত্তির্ণ হয়। অষ্টম এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে বৃত্তি পায়। শুধু দশম শ্রেণিতে ৪.৬১ জিপিএ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সংগ্রামের বিষয় জানতে চাইলে বলেন, কলেজে থাকা অবস্থায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত টিউশন পড়াতাম। এখনো এক জায়গায় অনলাইনে পড়াই।
তবে টাকার বিনিময়ে নয়। ভালো লাগার জায়গা থেকে। কলেজ পরীক্ষা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। করোনার কারণে তেমন ভালো কোচিং এ পড়তে পাড়িনি। তাই একটা কোচিং এ বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তির জন্য অনলাইন কোচিং করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা দেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় না থাকলেও রাবিতে ১৪৪ মেধা তালিকায় ও গুচ্ছতে ৬৬ নম্বর পেয়ে আমার মেধা তালিকা আসে। সিদ্ধান্ত নিই রাবিতে পড়বো। তাই গুচ্ছতে
যাইনি।
বাবার মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জানাতে চাইলে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি জানান, আমাদের বাড়ি হাই-রোডের পাশেই। সেসময় আমি এসএসসিতে পড়াশোনা করি। আমার বাবা মো. সাইদুর রহমান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অবসর নেওয়ার আর মাত্র পাঁচ বছর বাকি। একদিন একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাদের বাড়িতে আঘাত করে এতে ঘরের দেয়াল ভেঙে বাবা চাপা পড়ে এবং মারা যায়। সেই ঘটনা পেপারেও এসেছিলো। আমরা মামলা করেছিলাম। কিন্তু ট্রাক ড্রাইভারের কিছুই হয়নি।
তার স্বপ্নের বিষয় বলেন, ২০১৯ সালে আমার বাবা যখন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। সে বিচার এখনও না পাওয়ায় আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বড় আইনজীবী হবো। আমার মেধা ও ভাগ্যক্রমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাই। তাই স্বপ্ন দেখি একদিন অনেক বড় আইনজীবী হবো আর আমার বাবার মৃত্যুর সঠিক বিচার মাকে এনে দিবো।
রিফাতের মোটিভেশনাল বই পড়তে, ঘুরতে ও তাহসানের গান শুনতে ভালো লাগে। তাহসানের, বিন্দু আমি, আলো আলো তুমি কখনো, গান শুনি। রিফাত রহমানের বিষয় আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক এম হাসিবুল আলম প্রধানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, তাকে আমি চিনি এবং জানি। এজন্য ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে পর থেকে ব্যক্তিগত ভাবে খোঁজ খবর রাখি তার সাথে।
তার বন্ধুরা ও বিভাগের সবাই যাতে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয় তার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। তার যেকোনো সমস্যা আমরা গুরুত্বের সাথে দেখছি। কারণ সে অনেক মেধাবী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আইন বিভাগে মেধা তালিকা থেকে ভর্তি হয়েছে। আমি তার ভবিষ্যৎ আরো উজ্জ্বল হোক এই কামনাই করি।
ধরমপুর থেকে ক্লাস আসার সমস্যার বিষয় এবং হলে থাকার ব্যবস্থার বিষয় তিনি বলেন, তার মা-সহ সে ভাড়া বাসা থাকে এবং অনেক দূর থেকে ক্লাসে আসে। সে যদি এই বিষয় আমাদের বলে তাহলে আমি তার হলের প্রাধ্যক্ষ ও প্রশাসনকে বলে হলে থাকার ব্যবস্থা করবো। কারণ প্রশাসন এ বিষয়ে এখন অনেক সচেতন।
এএজেড