মুখ থুবড়ে পড়েছে কেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা?
প্রাচ্যের কেম্ব্রিজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাখাতে এখন নিভু, নিভু। কেন? লিখেছেন মাহমুদুল হাসান
প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে এবং অকেজো যন্ত্রপাতির কারণে গবেষণায় পিছিয়ে পড়ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কোনোমতে গবেষণা চালিয়ে নিচ্ছেন তারা। আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দারস্থ হতে হচ্ছে তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রকৌশল, বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, কৃষি, মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদসহ বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি বিভাগের ল্যাবগুলোতে অধিকাংশ যন্ত্রাংশ অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।
অধিকাংশ বিভাগের ল্যাবগুলোতে নেই প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল ও যন্ত্রপাতি। ফলে থিসিসসহ গবেষণাধর্মী সকল কাজেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের বিভাগের ল্যাবের মাইক্রোটোম মেশিনগুলো ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় কাক্সিক্ষত রিবন পাওয়া যায় না। যে রিবন আসে, সেটা মাইক্রোস্কোপে দেখার সময় টিস্যুর ক্রাইটেরিয়াগুলো বোঝা যায় না। দেখা যায়, রিবন এসেছে কিন্তু কুঁচকে গিয়েছে। ল্যাবে যতগুলো মাইক্রোস্কোপ মেশিন আছে, সবগুলোরই কার্যক্ষমতা কম। ফলে ভালোমতো কাজ করা যায় না এগুলোতে।’
তিনি আরো বলেন, ‘মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা অনেক ইনস্ট্রুমেন্টের অভাবে থিসিসের কাজ সম্পূর্ণ করতে পারেন না। আমাদের মাস্টার্সের ছয়টা ব্রাঞ্চের মধ্যে দুই-তিনটির ইনস্ট্রুমেন্ট মোটামুটি ভালো হলেও বাকিগুলোর একেবারেই চলে না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনো বিভাগের ল্যাব ইনস্ট্রুমেন্টের সাহায্য নিতে হয়। এমনকি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বা সরকারি কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ল্যাবে গিয়েও কাজ করা লাগে আমাদের। তাতে অর্থ ও সময় দুটোরই অপচয় হয়।’
অ্যাগ্রোনমি অ্যন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের ছাত্র আব্দুল মাজেদ হাওলাদার বলেছেন, ‘প্রতিটি বিভাগের জন্য আলাদা ল্যাব থাকার কথা থাকলেও আমাদের বিভাগে ওরকম পৃথক ল্যাব নেই। আমাদের শুধু প্যাথলজি ল্যাবই আছে। এজন্য স্নাতকের শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্তভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি না। যেগুলো না দেখালেই না, স্যাররা সেই কাজগুলো দেখিয়ে দেন। মাস্টার্সের ল্যাবের কাজগুলোর জন্য আমাদের অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট বা সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করতে হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ক্লাসরুমে ক্লিন বেঞ্চ থাকে, কিন্তু সেটি ল্যাবে থাকার কথা। পর্যাপ্ত পরিমাণে কেমিক্যাল থাকে না, রুমের সংকট আছে। প্রয়োজনীয় সবগুলো যন্ত্রপাতি নেই। আবার মৌলিক যে কয়টা যন্ত্র আছে, সেগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। এজন্য সিনিয়ররা কাজ করলে জুনিয়ররা আর কাজ করার সুযোগ পায় না।’
পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ এবং কেমিক্যালের অভাবে শিক্ষার্থীদের উন্নত দেশের মতো গবেষণা সুবিধা দিতে পারছেন না জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ও ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক এবং মাছ গবেষক ড. ইয়ামিন হোসেন বলেন, ‘যেখানে প্রতিনিয়ত গবেষণার ধরণ পাল্টাচ্ছে, সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল বিভাগের ল্যাবগুলোর কোনোটাতে কেমিক্যাল সংকট আবার কোনোটাতে যন্ত্রাংশ থাকলেও সেগুলো সচল করার মতো ফান্ড নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের গবেষণা কার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তাদেরকে আমরা উন্নত দেশের মতো গবেষণা সুবিধা দিতে পারছি না।’
বিশিষ্ট গবেষক ‘দ্য ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সেস (টোয়াস)’ সদস্য এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘গবেষণাগারগুলোতে যন্ত্রাংশের সংকটের ফলে শিক্ষার্থীদের গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি যে সকল শিক্ষকরা গবেষণার করেন তারাও অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন এখানে। আমাদের যে গবেষণা অনুদানগুলো দেওয়া হয়, প্রায় পুরোটাই কেমিক্যাল ও গবেষণার সরঞ্জাম কিনতেই ব্যয় হয়ে যায়। প্রতিটি ল্যাব চালাতে গেলে একটি রানিং কস্ট ও মেইনটেনেন্স কস্ট লাগে কিন্তু গবেষণা অনুদানে বা প্রকল্পে এই কস্টগুলো উপেক্ষিত থেকে যায়।’
তিনি বলেন, ‘গবেষণার সকল ধরণের সংকটের বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজর দেওয়া উচিত। গবেষণাগারগুলো দেখভাল করার জন্য কিছু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের দরকার। অনেক গবেষণার কার্যক্রম এখানেই হওয়ার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের সংকটের ফলে শিক্ষার্থীদের ঢাকা গিয়ে অথবা বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারে গিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। সেখানেও যে তারা খুব ভালো সেবা পাচ্ছে এমনটিও না।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, “কোনো বিভাগের ল্যাবের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের কোনো যন্ত্রপাতি অকেজো থাকলে বা না থাকলে, সংশ্লিষ্টরা আমাদের জানালে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব। আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বৃহত্তর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বিসিএসআইআর’-এর সাথে ‘এমওইউ’ স্বাক্ষর করেছি। এখন গবেষণা সংশ্লিষ্টদের জন্য ‘বিসিএসআইআর’ থেকে আমরা সহজেই সহায়তা নিতে পারব।”
ওএফএস।