অচল জাকসুতে সচল আয়ের খাত
দীর্ঘ ৩০ বছর যাবৎ অচল রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু)। অচলাবস্থার কারণে অধিকার ও স্বার্থসংরক্ষণের দাবি তুলতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। তবে জাকসু বন্ধ থাকলেও চালু রয়েছে এ খাতের আয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জাকসু ও হল সংসদ বাবদ টাকা আদায় করা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বলছে জাকসুর তহবিলে কোনো অর্থ নেই। এ ছাড়া বার্ষিক বাজেটে গত কয়েক বছরে জাকসুর জন্য ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা কখনো ব্যয় হয়নি।
১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। এরপর ‘৭৪, ‘৭৯, ‘৮০, ‘৮১, ‘৮৯, ‘৯০, ‘৯১ এবং ‘৯২ সালে জাকসু নির্বাচন হয়। গঠনতন্ত্রে প্রতিবছর নির্বাচনের কথা থাকলেও ৫১ বছরে নির্বাচন হয়েছে মাত্র ৯ বার। সর্বশেষ ১৯৯২ সালের নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মাসুদ হাসান তালুকদার এবং জিএস শামসুল তাবরীজ। এরপর থেকে প্রায় ৩০ বছর জাকসু নির্বাচন হয়নি।
গত ৩০ বছরে শিক্ষার্থী ভর্তির সময় জাকসু ও হল সংসদ বাবদ অর্থ আদায় করা হয়েছে। ১৯৯১-৯২ সেশন (২২ ব্যাচ) থেকে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন মোট ৪৪ হাজার ৩৪৮ জন শিক্ষার্থী। ভর্তির সময় জাকসুর জন্য ১৫ টাকা এবং হল সংসদ বাবদ ১৫ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। ফলে গত ৩০ বছরে প্রায় ২৭ লাখ টাকার বেশি আদায় করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পট্রোলার অফিসের তথ্য মতে, জাকসুর কোষাগারে কোনো অর্থ নেই। জাকসুর ৩৭০১নং হিসাবে কোনো টাকা জমা থাকে না। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শাখায় প্রায় ৬ লাখ টাকার মতো জমা হয়। এ ছাড়া জাকসু বাবদ প্রতিবছর বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও এ খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটে ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর আগের বছরগুলোতেও এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়। তবে সেই বরাদ্দের টাকা আর এ খাতে খরচ হয় না।
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক রাশেদা আখতারের অফিসে একাধিকবার গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তাকে মুঠোফোনে কল দিলেও রিসিভ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পট্রোলার (ভারপ্রাপ্ত) মোসানুল কবির বলেন, ‘কোন খাতে কত টাকা আছে তা আমরা এভাবে বলতে পারি না।’ তবে কম্পট্রোলার অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, জাকসুর নামে টাকা নেওয়া হলেও জাকসুর ফান্ডে কোনো টাকা জমা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঞ্চের আহ্বায়ক ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জাকসুর জন্য আদায়কৃত টাকা সঠিক খাতে ব্যয় হচ্ছে না। যদি শিক্ষার্থীদের পেছনে এই অর্থ ব্যয় না হয়, তাহলে এটাকে এক ধরনের দুর্নীতি বলা চলে। গণতান্ত্রিক চর্চা বজায় রাখার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাকসু নির্বাচন হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হচ্ছে কিন্তু সেখানে শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি থাকবে না! উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের আগেই জাকসু নির্বাচন হওয়া দরকার।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক ছাত্রের বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে তৎকালীন প্রশাসন জাকসু ও হল সংসদ বাতিল করে। জাকসু নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-১৯৭৩ অনুযায়ী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি পর্ষদ সিনেটে অন্যান্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে অ্যাক্টের ১৯ (১) (ক) অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ থেকে ৫ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় সিনেটের অধিবেশন বসেছে ছাত্র-প্রতিনিধিদের মনোনীত সদস্য ছাড়াই। ফলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে।
২০১৩ সালে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন দায়িত্বে থাকার সময় জাকসু নির্বাচন নিয়ে ক্যাম্পাস সরগরম হলেও পরবর্তীতে তা আর হয়নি। তিনি চলে যাওয়ার পর জাতীয় নির্বাচন ও আইনি জটিলতায় ২০১৪ সালে ২ জানুয়ারি জাকসু নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৯ সালের ২৮ জুন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম সেই বছরের নভেম্বরের মধ্যে জাকসু নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেন। তবে সে প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন হয়নি। তখন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলেও সেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার চলে গেছেন অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে (এলপিআর)। এরপর থেকে জাকসু নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি। ফলে জাকসুর দাবিতে সব ছাত্র সংগঠন একাত্মতা জানালেও তার বাস্তবায়ন হয়নি।
ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সভাপতি রাকিবুল রনি বলেন, ‘শিক্ষার্থী ছাড়া বাকি সকলের আনুগত্য পাওয়া প্রশাসনের পক্ষে সহজতর হয় বলেই শিক্ষক,কর্মকর্তা ,কর্মচারী সকলের নির্বাচন হলেও জাকসু নির্বাচন দেওয়া হয় না। নির্বাচন না হলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মুলা ঝুলাতে বরাবরই সিদ্ধহস্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জাবির শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন বলেন, ‘জাকসু না দেওয়ার ফলে আমাদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। জাকসু থাকলে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার জায়গা তৈরি হয়। আমরা প্রশাসনকে এ নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছি।’
এ বিষয়ে জানতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমকে একাধিকবার ফোন করলেও পাওয়া যায়নি।
এসজি/