শাবিতে ৮ স্থান অরক্ষিত, নিরাপত্তাহীনতায় শিক্ষার্থীরা
বুলবুল হত্যাকাণ্ডের পর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দূরদর্শিতার অভাব ও দায়হীনতাকে দায়ি করছেন। তাদের দাবি- রাত সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় এমন ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতি প্রমাণ করে শাবিপ্রবি ক্যাম্পাস এবং হলে থাকা আবাসিক শিক্ষার্থীর ব্যাপারে কোনো দায় নেই সংশ্লিষ্টদের।
কর্তৃপক্ষের দায়হীনতার কারণে অকালেই প্রাণ দিতে হয়েছে শিক্ষার্থী বুলবুলকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই বারবার এ বিদ্যাপীঠ কোনো না কোনো ঘটনায় সারাদেশে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
বুলবুল হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার তিন আসামির কারো নামে এর আগে ছিনতাইয়ের কোনো মামলা নেই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায় ছিনতাই করতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে বুলবুল নিহত হন।
এর আগে চলতি বছরের শুরুতে শিক্ষার্থী আন্দোলনের কারণে পুরো এক মাস অস্থিতিশীল ছিল দেশের অন্যতম এ বিদ্যাপীঠ। সেই রেশ পুরোপুরি শেষ হতে না হতেই ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বুলবুল নিহতের ঘটনায় আবারও আলোচনায় শাবিপ্রবি। নিহত বুলবুল লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি নরসিংদী সদরের নন্দীপাড়া গ্রামে। এ ঘটনায় সন্দেহের তালিকায় থাকা বুলবুলের বান্ধবীর নাম মার্জিয়া ঊর্মি। তিনি শাবির বাংলা বিভাগের ছাত্রী। তার বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলায়।
এদিকে, বুলবুল খুনের পর শাবি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত আটটি স্থান অরক্ষিত। গাজী-কালুর টিলাসহ কয়েকটি এলাকায় বহিরাগত মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে প্রায়ই শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে হাঁটাচলা করতেও অনিরাপদ বোধ করেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিলারগাঁও এলাকার পাঁচটি স্থানে সামীনা প্রাচীরের নিচ দিয়ে কে বা কারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রেখেছে। কাঁটাতারের বেড়াও কেটে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের পেছনের টিলা ও কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের পাশে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই। এসব স্থানে কোনো নিরাপত্তাকর্মীও নেই। সহজেই এসব স্থান দিয়ে বহিরাগতরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে নানা অপরামূলক কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, কয়েকটি স্থান ছাড়া সবখানেই সীমানা প্রাচীর আছে। তবে বহিরাগত ব্যক্তিরা প্রাচীর টপকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েন। তারা ক্যাম্পাসে ঢুকে তুলনামূলক নির্জন স্থানে ওঁৎ পেতে থাকেন। একা কিংবা দুজন শিক্ষার্থী এসব এলাকায় গেলেই ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালানো হয়। অনেক সময় বহিরাগতরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্জন জায়গায় বসে মাদক সেবনও করেন।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন সিলেট জেলা আহবায়ক অধ্যাপক জান্নাত আরা খান পান্না বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় একজন শিক্ষার্থী খুনের ঘটনা নিঃসন্দেহে খুবই দুঃখজনক। এ দৃশ্য অভিভাবকদের জন্য খুবই আতঙ্কের। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি জেনেই থাকে, এ স্থান ছিনতাইকারীদের স্বর্গরাজ্য, তাহলে এতদিন তারা বিষয়টির প্রতিকার করলেন না কেন? তা ছাড়া হল প্রভোস্টও এর দায় এড়াতে পারেন না। সন্ধার পর শিক্ষার্থীদের হলে অবস্থান নিশ্চিত বা তাদের সম্পর্কিত তথ্য মনিটরিং ব্যবস্থা থাকাটাও বাঞ্চনীয়। তিনি সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষ দ্রুত ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনের দাবি জানান।
একই অভিমত আইনজীবী মোহাম্মদ মনির উদ্দিনের। তিনি বলেন, ঘটনার পর কেন বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে? যেহেতু ক্যাম্পাস সংলগ্ন স্থানটি মনোরম পরিবেশে অবস্থিত-সেখানে শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ থাকাটাই স্বাভাবিক। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকার পরিবেশ হবে অনেকটাই নিরাপত্তা ও নির্ভরতার। নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব থাকলে এ রকম ঘটনা বারবার ঘটবে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে শাবি ক্যাম্পাস কিছুটা ‘অরক্ষিত’- এমন বক্তব্য পাওয়া গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্যেও। মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) খুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ। এসময় উপস্থিত ছিলেন শাবি ভিসি ফরিদ উদ্দিন। তিনি এসময় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য আমরা সীমানা প্রাচীর দিয়েছি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বহিরাগতরা এসে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালায়। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সীমান প্রাচীর আছে তা পুরো সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা।
তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু দুষ্কৃতকারী আছে- যারা বালির বস্তা দিয়ে দেয়ালের উপর দিয়ে ভেতরে চলে আসে। এ ছাড়াও তারা মই লাগিয়ে রাখে এবং দেয়ালের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ করে ঢুকে পড়ে। এভাবে ঢুকে দুষ্কৃতকারীরা আমাদের বনের গাছগুলো পুড়িয়ে ফেলেছে। আমরা এখন পুরোটাই কাটাতারের বেড়া দেব। আমরা চেষ্টা করছি বহিরাগতদের প্রবেশ পুরোপুরি প্রতিহত করার।
এদিকে, বুধবার (২৭ জুলাই) বেলা ১১টায় নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন- শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় আমরা পুরো ক্যাম্পাসে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছি এবং কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছি। আমরা চাই শিক্ষার্থীদের যাতে শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বন্যায় ক্যাম্পাস পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অনেকগুলো সিসি ক্যামেরা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো মেরামত করার চেষ্টা করছি। আগে অনেক সমস্যা ছিল, আমি আসার পর একটার পর একটা সমস্যা সমাধান করেছি। ক্যাম্পাসে আগে মাদকের ছড়াছড়ি ছিল, র্যাগিং নামক বড় সমস্যা ছিল। সেটি এখন আর নেই। আমরাই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডোপ টেস্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ব্যবস্থা করেছি।
জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজমুল হুদা খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে পুলিশ ঢুকতে পারে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় নিয়মিত টহল দেয় পুলিশ। বর্তমানে শাবির আশপাশের এলাকায় টহল আরও বাড়াানো হয়েছে।
এ মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলেন- শাবির পেছনের টিলাগাঁওয়ের আবুল হোসেন, কামরুল আহমদ, মো. হাসান। বুলবুল হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আখতারুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এসএন