চিরসবুজ মতিহারের বাতিঘরের জন্মদিন আজ
লেখা ও ছবি : মাহমুদুল হাসান, প্রতিনিধি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
‘প্যারিস রোডে যদি কোন একদিন দেখা হয়ে যায় ব্যস্ত সময়ে, তবে কি তোমার হৃদয়ের কাঁটা কম্পাস ঘুরতে থাকবে আমার দিকে-এই প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রীরা প্রেমিক ও প্রেমিকার দিকে। তারা একে, অন্যের দিকে হৃদয়ের কাঁটা ঘোরাতে পারুন বা নাই পারুন, সবার হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয় সবসময় তাদের বিশ্ববিদ্যালয়। তারা যান প্যারিস রোডে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস নয়, অবস্থান বাংলাদেশেই। দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আজ ৬ জুলাই। বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত ও সেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৯ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আজ সে পা রাখলো ৭০ বছরে।
‘এসো উৎসুক চিত্ত এসো অবারিত প্রাণ’ প্রতিপােদ্যে নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালিত হচ্ছে বাংলাদেশের চিরতরুণ এই ক্যাম্পাসের জন্মদিন। ১৯৫৩ সালের এই দিনে জন্ম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকে সে অনেক বড়, বিপুল তার আয়তন, বিরাট তার গৌরবের ভার।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দ শোভাযাত্রা শেষে সাত দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেছেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আজ ৬৯ বছর পার করে ৭০ বছরে পা দিল। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তা হলো, জ্ঞান সৃজন ও সঞ্চালন করা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এরপর বলেছেন, ‘এই কাজে আমরা পুরোপুরি সফল না হলেও তুলনামূলকভাবে এগিয়ে। আমাদের যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামনে রেখেই একাডেমিক মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছে, যা পূর্বে ছিল না। আমরা প্রায় ১১৩টি বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবেন। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার।’
‘বর্তমানে নানা কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকছে না। কাঠামোগত উন্নয়ন হলেও গুণগত মানোন্নয়ন হচ্ছে না। মতিহারের সবুজ চত্বর এসব পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে যাবে। জ্ঞান উৎপাদন, গবেষণা ও শিক্ষায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পরবে বিশ্বময়’ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।
প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন এখন। ‘প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ’ খ্যাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে, মূল রাজশাহী শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ব্রিটিশ যুগে রাজশাহী অঞ্চলের শিক্ষা, দীক্ষার উন্নয়নের জন্য ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজশাহী কলেজ। সে আমলে এই কলেজে আইন বিভাগসহ পোস্ট গ্রাজুয়েট শ্রেণী চালু ছিল। কিন্ত এর কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায় এসব শিক্ষাকার্যক্রম।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার দেশের সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। রাজশাহীতে এ সময় স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে শুরু হয় আন্দোলন।
১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের আদলে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ’ পাস করার সর্বপ্রথম দাবি তোলেন।
১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শহরের ভুবন মোহন পার্কে রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য সর্বপ্রথম জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৩ই ফেব্রুয়ারি ভূবন মোহন পার্কেই আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ এমএলএ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় আরও একটি জনসভা। উক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন ইদ্রিস আহমেদ এমএলএ, প্রভাষচন্দ্র লাহিড়ী, খোরশেদ আলম, আনসার আলী, আব্দুল জব্বার প্রমুখ। এভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ক্রমেই তীব্র হতে থাকে।
এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে গিয়ে কারারুদ্ধ হন ১৫ ছাত্রনেতা।
পরে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ঢাকায় একটি ডেলিগেশন পাঠানো হয়। ডেলিগেশনের সদস্যদের মধ্যে মরহুম আবুল কালাম চৌধুরী ও আব্দুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য।
একের পর এক আন্দালনের চাপে স্থানীয় আইন পরিষদ রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়। এই আন্দোলনে একাত্ব হন পূর্ববঙ্গীয় আইনসভার সদস্য প্রখ্যাত আইনজীবী ও জননেতা মাদার বখশ।
১৯৫৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভুবন মোহন পার্কে আরও একটি জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে জননেতা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাদার বখশ সরকারকে হুশিয়ার করে বলেন, ‘যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না হয় তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে আমরা বাধ্য হব।’ এই বক্তব্যে সাড়া পড়ে দেশের সুধী মহলে এবং সাথে, সাথে টনক নড়ে সরকারের।
অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাশ হয়।
নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইতরাত হোসেন জুবেরীকে সঙ্গে নিয়ে মাদার বখশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এ দুজনকে যুগ্ম সম্পাদক করে মোট ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার এম. এ. খুরশীদ।
১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই ড. ইতরাত হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য নিয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। শুরুতে ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম ক্লাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয় রাজশাহী কলেজে।
১৯৫৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয় মতিহারের নিজস্ব ক্যাম্পাসে। বর্তমান ক্যাম্পাসে দালান-কোঠা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হয়।
১৯৬৪ সালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অফিস ও বিভাগ এখানে স্থানান্তরিত হয়। ক্যাম্পাসটি গড়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি ড. সোয়ানি টমাসের স্থাপত্য পরিকল্পনায়।
১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ও রসায়নের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার প্রাণের বিনিময়ে বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের ইতিহাসে যুক্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।
মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্বেই বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ হবিবুর রহমান, শহীদ মীর আবদুল কাইয়ুম, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন শিক্ষক মজিবর রহমান। আরও ত্রিশ জন ছাত্র, কর্মচারী-কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বর্তমান প্রতীকের রূপ দেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী হাশেম খান।
প্রায় ৭৫৩ একর বা ৩শ ৪ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
রয়েছে ৫টি উচ্চতর গবেষণা ইন্সটিটিউট, ৯টি অনুষদের অধীনে ৫৬টি বিভাগে বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।
ক্যাম্পাসের উত্তর, পূর্ব দিক জুড়ে রয়েছে ছাত্রদের জন্য ১১টি আবাসিক হল।
পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ছাত্রীদের জন্য ৬টি আবাসিক হল।
মোট ১৭টি হল আছে এখন।
পূর্ব দিকে বাইরের গবেষকদের জন্য রয়েছে একটি ডরমিটরি।
পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে রয়েছে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’ এদেশের সর্বপ্রথম স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
রয়েছে সুবিশাল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় মসজিদ, কেন্দ্রীয় মন্দির, সাবাস বাংলাদেশ ভাষ্কর্য, বুদ্ধিজীবী চত্বর, বধ্যভূমি স্মৃতিফলক, গোল্ডেন জুবলি টাওয়ার ও বেড়ানো, আড্ডার বিখ্যাত প্যারিস রোড। আরো কত কী যে আছে, সে হিসেব কারো কাছে নেই।
ওএস।