অস্থির হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
একের পর অপ্রীতিকর ঘটনায় অস্থির হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চলতি মাসেই কয়েকটি ঘটনার পর দফায় দফায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক অবরোধ করে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা।
সবচেয়ে বেশি সমালোচিত ঘটনা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি,ঘুষ ও অডিও ক্লিপ ফাঁস। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস।
শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপ সিক্সটি নাইনের হামলা
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ২০২০-২১ সেশনের ছাত্র কফিল উদ্দিন সামির ওপর অতর্কিত হামলার প্রতিবাদে গত সোমবার (২৮ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা দেন শিক্ষার্থীরা। এ হামলার অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপ সিক্সটি নাইনের বিরুদ্ধে। প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে রবিবার (২৭ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে কফিল উদ্দিন সামির ওপর সিক্সটি নাইন গ্রুপের ৫-৬ জন কর্মীরা হামলা করেন। লোহার রড ও ইট দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেন তারা।
ফারসি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত 'আর্থিক লেনদেনের' অডিও ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে ফাঁস হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
গত ৩ মার্চ ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণি পদে ১২ লাখ, চতুর্থ শ্রেণি পদে ৮ লাখ, অফিসার পদে ১৫ লাখ ও শিক্ষক নিয়োগে ১৬ লাখ টাকার উপরে লেনদেন হয় বলে তথ্য উঠে আসে। এরমধ্যে একটি কল রেকর্ডে প্রভাষক পদের এক প্রার্থীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পিএসকে অর্থ লেনদেনের বিষয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলতে শোনা যায়।
ফাঁস হওয়া সেই ফোনালাপে একজন আবেদনকারীকে উপাচার্যের একান্ত সহকারী খালেদ মিছবাহুল মোকর রবীনকে কথা বলতে শোনা গেছে। বাকি দুইটিতে উপাচার্যের ভাতিজা ও এক বিভাগীয় সভাপতিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব নিয়ামক শাখার এক কর্মচারীর আর্থিক লেনদেনের নানা বিষয়ে কথোপকথন শোনা যায়। পরে ৫ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেটের ৫৩৭তম সভায় ফারসি বিভাগের নিয়োগ বোর্ড বাতিল করা হয়।
পরবর্তীতে ফারসি বিভাগের মতো অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের বেলাতেও ‘অর্থ লেনদেনের আশঙ্কা’ তুলে ধরে সেগুলো বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মূল ফটক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শাখা ছাত্রলীগের একাংশের নেতা-কর্মীরা। ৫৩৭তম সিন্ডিকেট সভায় নেওয়া সব সিদ্ধান্ত বাতিল করার দাবি জানান।
ফ্রিতে খবার না দেওয়ায় সোহরাওয়ার্দী হলের বাবুর্চিকে মারধর
৮ মার্চ বিনামূল্যে খাবার না দেওয়ায় সোহরাওয়ার্দী হলের বাবুর্চি আবুল হাসেমকে মারধরের অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের তিন কর্মীর বিরুদ্ধে। অভিযুক্তরা শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপ বিজয়ের কর্মী।
অভিযুক্ত তিনজন দর্শন বিভাগের র্যাগ ডে অনুষ্ঠানের জন্য রান্না করা খাবার থেকে ফ্রিতে তিনটি প্যাকেট নিতে চান। এ সময় বাবুর্চি হাসেম তাদের খাবার দিতে অস্বীকৃতি জানালে অভিযুক্তরা ১ হাজার টাকা দিতে বলেন। টাকা না দেওয়ায় তারা মারধর করেন বাবুর্চি হাসেমকে। মারধরে পেট ও মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হয়। পরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
চবি ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন হওয়ায় প্রায়ই তুচ্ছ ঘটনা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উপগ্রুপগুলো সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। গত ৯ মার্চ ছাত্রলীগের বিবাদমান বিজয় ও সিএফসি গ্রুপের মধ্যে আবারও সংঘর্ষ হয়। এসময় দুই গ্রুপের নেতা-কর্মীরা ইট পাটকেল, ককটেল নিক্ষেপ করেন। এ ছাড়া তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র, দা, রড দেখা যায়। চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। মূলত অর্থনীতি বিভাগের র্যাগ ডের অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডায় এ সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।
পরে ওই রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি শাহ আমানত ও সোহরাওয়ার্দী হলে তল্লাশি চালিয়ে রামদা, লোহার পাইপ, পাখি শিকারের গুলতি, বটি, ককটেল, ছুরি ও কাচের বোতল উদ্ধার করে।দুই গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের পর এ অভিযান চালানো হয়।
প্রীতিলতা হলে প্রভোস্ট অবরুদ্ধ
ছাত্রলীগের রাতের সংঘর্ষের ঘটনা শেষ হতে না হতে ১০ মার্চ মেয়েদের প্রীতিলতা হলে প্রভোস্টের কক্ষে তালা মেরে প্রভোস্টসহ আবাসিক শিক্ষকদের এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। সে সময় নিম্নমানের খাবার পরিবেশন ও কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগে আন্দোলনের ডাক দেন শিক্ষার্থীরা। পরে প্রক্টরের আশ্বাসে আন্দোলন তুলে নেন তারা।
চবি উপাচার্যসহ ৪ জনকে হাইকোর্টের নোটিশ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারসহ চারজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও কেন অন্য বিভাগের শিক্ষককে সভাপতি করা হয়েছে- এ ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়ে নোটিশ দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি আইন মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রিট পিটিশন ২০২২ এর ২৯২৭ নম্বরে এসব তথ্য দেওয়া হয়।
এর আগে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিধি লঙ্ঘন করে অন্য বিভাগের শিক্ষককে সভাপতি রাখার অভিযোগে হাইকোর্টে রিট করেন ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেনসহ তিন শিক্ষক।
উপাচার্যের পিএসসহ বহিষ্কার ২
গত ১৬ মার্চ (বুধবার) শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় উপাচার্যের পিএস খালেদ মিসবাহুল মোকর রবীন ও কর্মচারী আহমেদ হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
চবি উপাচার্যকে নিয়ে আপত্তিকর পোস্ট
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে হেয় করে একটি ওয়েব পেইজে পোস্ট দেওয়া হয়। ‘CU Dark Memes’ নামে ওয়েব পেইজে ওই পোস্ট দেওয়া হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও ক্যাম্পাসে অস্থিশীলতা তৈরি হয়। এরই মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত পোস্টদাতাকে খুঁজে বের করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয় চবি কতৃপক্ষ। গত ২০ মার্চ (রবিবার) বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার দিবাকর বড়ুয়ার সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
শিক্ষার্থীকে সিএনজিচালকের মারধর
ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে এক সিএনজিচালক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন বলে অভিযোগ উঠে। এ ঘটনার প্রতিবাদে গত ২২ মার্চ টায়ার জ্বালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে আন্দোলন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর চারদিন পর আবার এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় তার চোখে ঘুষি মারেন আরেক সিএনজিচালক। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলক্রসিং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। চোখে চশমা থাকায় কাচ ভেঙে কাচের টুকরা চোখের ভেতরে ঢুকে যায়।
পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, ক্যাম্পাসে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য আমরা খুবই সতর্ক আছি। বিভিন্ন সময়ে যখন ছাত্রলীগের গ্রুপগুলোর সংঘর্ষে হতাহতের খবর পাই তখন আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হলগুলো তল্লাশি করি। তারপরে এর পেছনে অস্ত্র সরবরাহে যারা থাকে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে বারবার তালা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এর পেছনে কোনো সিন্ডিকেট কাজ করতে পারে। আবার কেউ উস্কানি দিতে পারে, সেজন্য আমরা সতর্ক আছি, যাতে সামনে এরকম ঘটনা আর না ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এখানে যারাই অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করবে বা করার চেষ্টা করবে আমরা কাউকে ছাড় দেব না। আমরা প্রক্টরিয়াল বডি সবসময় এ ব্যাপারে সজাগ আছি।
এসএন