প্রকাশকদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস ফলপ্রসূ হবে
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের মান নিয়ে আমার কোন সংশয় নেই। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২২সালের এখন পর্যন্ত করোনার একটি সংক্রমণ সৃজনশীল প্রকাশনাতে খুব ভাল রকম একটি ছোবল দিয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ছোবলের কারণে অনেক প্রকাশকই ক্ষতিগ্রস্থ। তবে সোজা হয়ে দাঁড়াবার জন্য চেষ্টা অব্যাহত আছে। আশা ভরসার জায়গা থেকে ২০২১ সালের বইমেলাটি আমাদের হতাশ করেছে। ২০২২সালের বই মেলার জন্য প্রকাশকেরা আবারও বুকে আশা বেঁধেছিল। প্রথম দিকে একটু বিঘ্নিত হয়েছে। তারপর যাইহোক, ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ থেকে মেলা শুরু হলো। আজকে মেলার প্রথমদিন মেলার যে চেহারা দেখলাম, সেটি দুই তিন সপ্তাহের হোক বা আরও বেশি, আমার মনে হচ্ছে বইমেলা ভাল হবে। যদি তাই হয়, তবে করোনার ছোবল থেকে প্রকাশকদের ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রয়াস সেটি ফলপ্রসূ হবে।
প্রকাশকরা কিছুটা এগিয়ে যাবে। তবে করোনা মহামারি সৃজনশীল প্রকাশনাকে যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্থ করেছে সেটি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে আরও দুই থেকে তিন বছর অথবা আরও বেশি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আমরা আশংকা করেছিলাম অনেকেই হয়তো অংশগ্রহণ করবে না। কিছুসংখ্যক যে পাইনি তা নয়, পাশাপাশি আমি সমিতির সভাপতি হিসেবে আমি দেখেছি, প্রচুর সংখ্যক দরখাস্ত এসেছে যারা নিজেদের আরও আপগ্রেটেড করতে চায়। অনেকেই প্যাভিলিয়ন পেতে চায়। নতুন করে ৬৩টি দরখাস্ত পেয়েছি, যারা নতুন করে বইমেলায় অংশগ্রহণ করতে চেয়ে আবেদন করেছে।
গত দেড় দুই দশক ধরে আমরা প্রবীণদের পাশাপাশি নতুন লেখক খুঁজে যাচ্ছি । নতুন লেখা নতুন লেখকের সন্ধান করছি প্রতিনিয়ত। একটি ভাল সংখ্যক নারী লেখক যেন থাকে। অধিক পরিমাণে তরুণ লেখক থাকে। সমসাময়িক উপন্যাস থাকে। প্রকাশকদের জায়গা থেকে আমরা আমাদের চেষ্টাটুকু করে যাচ্ছি। লেখার মানের দিক থেকে, লেখার পরিপক্কতার দিক থেকে, ভ্যারিয়েশনের দিক থেকে আমরা খুঁজে যাচ্ছি ভাল মান সম্পন্ন লেখক। আমি মনে করি, মান আপেক্ষিক বিষয়, যেটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে পরিবর্তিত হয়। একটি লেখাকে কেউ বলবে মান সম্পন্ন আবার কেউ বলবে মান সম্পন্ন নয়।
আপনারা জানেন, রবীন্দ্রনাথের একটি লেখা কলেজে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কয়টি ভুল আছে বের করার জন্য। কাজেই রবীন্দ্রনাথকেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছিল।এখন আমরা বলি, বাংলা সাহিত্যকে উনি একটি জায়গায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন। কাজেই পন্ডিতেরা তাদের মতো করে ভাববেন। আমরা আমাদের মানদণ্ডে যে বইটি প্রকাশের উপযোগী, সেই বইটি প্রকাশ করবো। লেখা সাহিত্যের মানের দিক থেকে কতটুকু উৎকর্ষ হতে পেরেছে বা পারেনি, এটি সময় বলে দিবে, গবেষকরা বলবেন, পাঠকদের চাহিদা কতটুকু পুরণ করতে পারলো কি পারলো না এ ব্যাপারে পাঠকরা যেমন বলতে পারে, একই সঙ্গে বই বিক্রির হিসাবটিতো প্রকাশকদের কাছে আছে।
বইমেলার সময়সীমা বৃদ্ধির একটি কথা শোনা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি পজিটিভ দিক বলে আমি মনে করি। কারণ একটি দিন বাড়লে, সেদিন যদি দশটি বই বিক্রি হয়, সেটিতো সংখ্যায় বাড়লো। প্রকাশকরা সেটি আশা করছেন। প্রধানমন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয় কি সিদ্ধান্ত আসে। আমি মনে করি একটি নির্দিস্ট সময় পর্যন্ত মেলার সময়সীমা বৃদ্ধি পাওয়া ভাল।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন, আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিক অঙ্গনকে আরও ব্যপকভাবে বাড়াতে হবে। আমরা বইকে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি আরও আগে। আমরা উপজেলা পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়েছি। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ৬৪টি জেলায় একযোগে বইমেলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটিও প্রধানমন্ত্রী জানেন। কাজেই কজগুলি হচ্ছে আমাদের। আমি আশাবাদী মানুষ, হতাশ নই।
একথা সত্য, তথ্য প্রযুক্তি আমাদের শিশুদের কিছুটা বই বিমুখ করে ফেলেছে। এমনকি অভিভাবকরাও একথাটি বলছেন। শিশুরা মোবাইল স্মার্ট ফোনের দিকে ঝুঁকছে বেশি। আজকাল শিশুদের এক্সট্রা কারিকুলামের প্রতি তাদের কোন আগ্রহ নেই। অভিভাবকরা যখন বলে তখনতো আর কারোরই এ বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না।
আমাদের প্রকাশনাটিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। তা না হলে আমরা মেধা সম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে পারবো না। জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে পারবো না। তাহলে মেধাসম্পন্ন জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ তৈরি করতে গেলে, আমাদের ভাল প্রকাশনা করতে হবে। ভাল প্রকাশনা করতে হলে প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলিকে হতে হবে সৃজনশীল ভাল মানুষ। যারা সৃজনশীল মেধা সম্পন্ন তাদেরকে এই পেশায় আসতে হবে। যারা সৃজনশীল প্রকাশনার নামে কিছু জঞ্জাল সৃষ্টি করছে, তাদের এসব থেকে বিরত থাকতে হবে।
বাংলা একাডেমিতে প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলার যে আয়োজন করা হয়, সেই আয়োজনকে ঢেলে সাজাতে হবে। এরকমভাবে প্রকাশনার মানসম্পন্ন, মানহীন, মৌসুমি, সবধরণের প্রকাশককে একসঙ্গে মিলিয়ে একটি বিশাল আয়তনের বইমেলা করার ফলে পাঠকদের বইমেলার প্রতি আগ্রহ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এত অধিক অংশগ্রহণে অধিক বই বের হচ্ছে। যদি নির্দিষ্ট সংখ্যক বই বের হতো, তবে মানসম্পন্ন বই বের হবে। পাঠকদেরও বই প্রকাশের সুযোগটা ভাল তৈরি হবে। সবকিছু মিলিয়ে এই পদ্ধতিকে কিছুটা সংস্কার করার দরকার আছে। সংস্কারটি আসলে সম্মিলিতভাবে করা দরকার। সেটি সরকারের পক্ষ থেকে যতটা না করা সম্ভব তার চেয়ে বেশি সম্ভব হচ্ছে নিজেরা পরিশুদ্ধ হওয়া। সৃজনশীল প্রকাশনাকে অন্য ব্যবসার সঙ্গে না মিলিয়ে একটি সৃস্টিশীল সেবামূলক ব্যবসা হিসেবে ধরে যারা এই কাজটি করার মন মানসিকতা সম্পন্ন তাদেরই কেবল এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত, অন্যদের নয়।
লেখক: প্রকাশক, সময় প্রকাশন