‘কুষ্টিয়ার তাঁতশিল্প’ গ্রন্থের শাব্দিক আলোচনা
কবে কখন কোন জিনিস আরম্ভ হয় কীভাবে–তা বলা যেমন কঠিন, ঠিক তেমনই তাঁতশিল্প সৃষ্টির রহস্য জানাও। গ্রাম-বাংলার ইতিহাস খোদনে অনুমান করা হয় বাবুই পাখির বাসা তৈরি দেখে হয়তো মানুষ বয়ন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পেয়েছিল! এমনটাই কি? ‘কুষ্টিয়ার তাঁতশিল্প’ গবেষণামূলক গ্রন্থটিতে কুষ্টিয়ার তাঁতশিল্পের ঐতিহ্যের কথাই বলা হয়েছে। শুরু হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে, শেষ হয়েছে বর্তমান কুষ্টিয়ার তাঁতিদের তাঁতশিল্প নিয়ে অতীত, বর্তমান বয়ে চলা জীবনের সংগ্রামী উপাখ্যান।
এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছি সূক্ষ্ম সুতাকে দক্ষতা দিয়ে সুনিপুণ হাতে মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে যাঁরা তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন সেইসব মানুষকে, সেইসব কারিকরদের, যারা নানান প্রতিকূলতার মাঝেও এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কণ্ঠধ্বনি প্রকাশনী থেকে প্রকাশ এবং প্রচ্ছদশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগরের নান্দনিক প্রচ্ছদে ৪৪৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থে ১০ পর্বে বিষদ বর্ণনায় তাঁতিদের শিল্পকর্ম, তাদের সামাজিক অবস্থা, বাংলার তাঁতশিল্প, কুষ্টিয়ার তাঁতশিল্প, নীল চাষ ও তাঁতি সম্প্রদায় এর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক, জীবন আচার, রং-নকশা, তাঁতযন্ত্রের বিবর্তন, কুষ্টিয়ার হারিয়ে যাওয়া মোহিনী মিল ও একজন মোহিনী মোহন চক্রবর্ত্তীর কর্মযজ্ঞ, তাঁতশিল্পে তাঁতি ও উদ্যোক্তাদের ভাবনা, সাহিত্যে কুষ্টিয়ার তাঁতশিল্প, তাঁত বোর্ড ও তাঁত কারখানা, হাট-বাজার এবং তাঁতশিল্পের বিকাশ, বাজারজাতকরণ, প্রতিবন্ধকতা ও পর্যালোচনা রয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁতশিল্পকে রক্ষার সবিনয় আবেদনও!
‘কুষ্টিয়ার তাঁতশিল্প’ যে এত সমৃদ্ধ, এই গ্রন্থ না লিখলে হয়তো কখনো জানতেও পারতাম না তাঁতশিল্প কত পুরাতন! আস্তে আস্তে কখন যে তাঁতশিল্প নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠলাম তা বলা বড়োই কঠিন। বিভিন্ন গ্রন্থ পড়ে বুঝতে পারি সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডটি যে কারণে পৃথিবীব্যাপী পরিচিত ও সুখ্যাতি অর্জন করেছিল, তার অন্যতম কারণ হলো এ দেশের তাঁতশিল্প। কুষ্টিয়ার তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা সরেজমিন অনুসন্ধানে বহুবার যাওয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষ তাঁতের সঙ্গে যুক্ত না থাকার জন্য নিজের অনুভূতি সেইভাবে বর্ণনা করা না গেলেও তাঁতিদের সাথে মিশে যেটুকু বুঝেছি তাই নিয়েই আলোচনা ও গ্রন্থ রচনা। কুষ্টিয়ার তাঁতশিল্পে পদচারণার কথা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও আলোচনা হয়েছে। স্বাধীন দেশে তাঁতশিল্পের কী কী পরিবর্তন, উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তাও আলোচিত হয়েছে। তাঁতশিল্পের উপাদান বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় আনন্দ-রূপের সন্ধান, প্রবল জীবনাগ্রহ, প্রতিবাদী চেতনা, ধর্ম-নির্বিশেষ অবহেলিত মানুষের কথা ও মানবতার অনুসন্ধান। আমাদের মনে হয়, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সভ্যতার প্রকৃত পরিচয় হতে পারে তাঁত–যা আয়নার মতো সত্য স্বচ্ছ।
তাঁতিদের নিয়ে লালন ফকির গান বেঁধেছেন-
আমার চরকা ভাঙা, টেকো আড়ানে
আমি টিপে সোজা করব কত, আর তো প্রাণে বাঁচিনে...
যা আজও বাংলার বাউল-গায়েন গেয়ে চলেন গ্রাম বাংলার পথে পাথে তাঁতিদের অন্তর ভেদ করে। তাঁতশিল্প বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য তথা কুষ্টিয়ার অন্যতম ঐতিহ্য। এক সময় কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীকে ‘তাঁতঘর’ বলা হতো। আর পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই কুমারখালীর কাপড়ের বিপুল চাহিদা ছিল ও আছে। কুষ্টিয়ার বস্ত্রশিল্প ও বাণিজ্যিক নানাদিক ‘কুষ্টিয়ার তাঁতশিল্প’ নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থের সার্বিক পর্যালোচনা। কুষ্টিয়ার তাঁতিদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার নানান টানাপোড়নের গল্প কাহিনি অবিশ্যি উন্মোচিত হয়েছে ‘কুষ্টিয়ার তাঁতশিল্প’ গ্রন্থে।
‘কুষ্টিয়ার তাঁতশিল্প’ গ্রন্থটি অনলাইনেও (রকমারি.কম) পাওয়া যাবে ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে।
গ্রন্থ রচয়িতা: ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন ও ড. সারিয়া সুলতানা
এসএ/