নানা সংকটে ধুকছে রাজশাহীর নাট্যচর্চা
রাজনৈতিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিভাজন, প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা সংকটে ধুকছে রাজশাহীর নাট্যচর্চা। তবে সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করছে কর্মী সংকট। গতানুগতিক ধারা থেকে ডিজিটালাইজেশনে রুপান্তরেও পিছিয়ে এ অঞ্চলের নাট্যচর্চা। এতে ঐতিহ্যবাহী বরেন্দ্র অঞ্চলের সংস্কৃতি চর্চাও দিন দিন স্তিমিত হয়ে পড়ছে।
রাজশাহীর স্থানীয় নাট্যকর্মীদের মতে, বরেন্দ্র ভূমি রাজশাহীতে নাট্যচর্চার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। সম্ভাবনাও প্রচুর। কিন্তু যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। প্রযুক্তির পালে হাওয়া লাগায় নতুন নাট্যকর্মীও তৈরি হচ্ছে না। একটা সময় নাট্যচর্চায় তরুণদের যে প্রাণোচ্ছলতা ও ভালোবাসা ছিল, সেটাও এখন সেইভাবে নেই। সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনেও অনেকে ছুটছেন। টিকটক, লাইকির মতো প্ল্যাট ফর্মে অদক্ষ-অশ্লীল আসক্তি সৃজনশীল নাট্যকর্ম সৃষ্টিতে বাধ সাধছে।
রাজশাহীর স্থানীয় মঞ্চকথা থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক হৃদয় রনি বলেন, নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা নাট্য চর্চায় খুব বেশি আগ্রহী না। যারা কাজ করছে, তাদের মাঝেও আর আগের মতো আন্তরিকতা দেখা যায় না। হাতের কাছে স্মার্ট ফোন। এতে এখন আর সেই মানের সৃজনশীল চর্চার জায়গাটাও নেই।
তিনি বলেন, সম্ভাবনা থাকলেও রাজশাহীতে নাট্যচর্চায় সেইভাবে এগোতে পারেনি। এক্ষেত্রে যে সংকটগুলো সেগুলোও প্রায় সবারই জানা। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও খুবই কম। এগুলো থেকে উত্তরণের পথ নিজ নিজ জায়গা থেকে নাট্য সংগঠকরা খুঁজছেন বলে মনে করেন তিনি।
রাজশাহী থিয়েটারের সাবেক সভাপতি কামারুল্লাহ সরকার জানান, রাজশাহীতে এক সময় খুব ভালো নাট্যচর্চা ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটা ক্ষয়িষ্ণু। রাজশাহীর নতুন প্রজন্মকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা প্রতিনিয়ত নাটক করছি। উৎসবের আয়োজন করছি। আর অনেকেই এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তারা যদি তাদের পূর্বপুরুষদের কথা মনে রেখে সক্রিয় হন তবে নাট্য আন্দোলন আরও গতিশীল হবে।
তিনি আরও বলেন, রাজশাহীতে বর্তমানে রাজশাহী থিয়েটার, রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ, সান্ধ্য প্রদীপ সাংস্কৃতিক একাডেমি, মঞ্চকথা থিয়েটার, রংধনু নাট্য একাডেমি, খেলাঘর, ইলামিত্র শিল্পী সংঘ, ভোর হলো- এই সংগঠনগুলোর অধিকাংশই এখন নিষ্ক্রিয়। যেটা হচ্ছে, সংগঠকরা অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়ায় এখানে সময় দিতে পারছে না। আবার প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন নাট্যকর্মীও তৈরি করতে পারছে না। এ ছাড়া সময়ের সঙ্গে নিজেকে আপডেট করাসহ নানা কারণ আছে। নাট্যচর্চা দিবসে প্রত্যাশা থাকবে এই সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমে রাজশাহীর নাট্যচর্চায় নতুন এক দিগন্ত রচিত হবে।
রাজশাহীতে স্থানীয় নাট্য সংগঠনগুলোর সঙ্গে একীভূত হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য সংগঠনগুলোও কাজ করে। স্থানীয় নাট্যচর্চাকারীদের ভাষ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনগুলোই বেশি সক্রিয় রয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে নাট্য সংগঠক হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক নাট্যকার ও নির্দেশক মলয় কুমার ভৌমিক।
তিনি বলেন, নাটক সব সময় সমাজের সত্য তুলে ধরে। এ কারণে তেমন কোনো পৃষ্ঠপোষকতা থাকে না। অনেকটা নিজের খেয়ে বনের বাঘ তাড়ানোর মতো করেই কাজ করেন নাট্যকর্মীরা। আর সংকটের কথা বললে, ১৯৪৭ এর পর থেকেই সংকট আছে। তবে নির্দিষ্ট কোনো সংকট না। রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সকল সংকটই আছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি যখন দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায়, আর রাজশাহীর মতো বিভাগীয় শহরে একটি ‘আধুনিক নাট্যমঞ্চ’ করা সম্ভব হয়নি। তখন সেটা হতাশার।
তিনি বলেন, রাজশাহীতে নাট্যচর্চা যে একটি লয়ে চলছিল, তা সাম্প্রতিক সময়ের কোভিড-১৯ একটি বড় ধাক্কা ছিল। তবে শুভ দিক হচ্ছে, আস্তে আস্তে সেটা থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু আপেক্ষের বিষয় হলো স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে একের অধিক বা ডজন খানেক নাট্যদল তৈরি হয়নি।
মলয় ভৌমিক আরও বলেন, নাটক হলো সাধনা ও অনুশীলনের বিষয়। কিন্তু বর্তমানে যুব সমাজ ও তাদের অভিভাবকরা এ বিষয়টিতে আগ্রহী নয়। একারণে কর্মী পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংকট ও অভিঘাতের চিত্র তুলে ধরে নাট্য আন্দোলনের গতিশীলতার প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেন তিনি।
এসএন