শুভ জন্মদিন হুমায়ূন আহমেদ
বাংলা সাহিত্যের অনন্য এক কলম জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ। ১৩ নভেম্বর তার জন্মবার্ষিকী। ভক্ত-অনুরাগীদের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছেন তিনি। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে জন্ম নিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিক।
ছোটবেলায় হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। ডাকনাম কাজল। তার বাবা নিজের নাম ফয়জুর রহমানের সঙ্গে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরবর্তীকালে তিনি নিজেই নাম পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদ রাখেন।
তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সব গ্রুপে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এমএসসি শেষে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন।
কর্মজীবনে প্রবেশ করেন ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় প্রথম লেখেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’।
১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় একসময় অধ্যাপনা ছেড়ে দেন তিনি।
১৯৭৩ সালে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর নাম গুলতেকিন আহমেদ। এ দম্পতির তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ ও ছেলের নাম নুহাশ হুমায়ূন।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। এর ফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসানকল্পে ২০০৫-এ গুলতেকিনের সঙ্গে তার বিয়ে বিচ্ছেদ হয় এবং ওই বছরই শাওনকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের ছাত্রজীবনে ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে সাহিত্যে যাত্রা শুরু করেন তিনি। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ তার দ্বিতীয় গ্রন্থ। এরপর দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে তিনি রচনা করেছেন তিনশর মতো উপন্যাস। যা বিশ্বসাহিত্যে একজন লেখক হিসেবে তাকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। তার রচনাসমগ্রের মধ্যে এইসব দিনরাত্রি, জোছনা ও জননীর গল্প, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথাও, সৌরভ, নি, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরীপুর জাংশান, বহুব্রীহি, আশাবরি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, আমার আছে জল, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, মাতাল হাওয়া, শুভ্র গেছে বনে, বাদশাহ নামদার, এপিটাফ, রূপা, আমরা কেউ বাসায় নেই, মেঘের ওপারে বাড়ি, আজ চিত্রার বিয়ে, এই মেঘ, রৌদ্রছায়া, তিথির নীল তোয়ালে, জলপদ্ম, আয়নাঘর, হুমায়ূন আহমেদের হাতে ৫টি নীলপদ্ম ইত্যাদি অন্যতম।
হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি চরিত্র হিমু, মিসির আলী কালজয়ী হয়ে আছে। এ ছাড়া নাটকে বাকের ভাই, মুনা, মাজেদা খালা, লীলাবতী, রূপা, কঙ্কা চরিত্ররাও বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের অন্তরে চিরস্থায়ী করেছে। একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন অনন্য। মোট ৮টি ছবি নির্মাণ করে গেছেন তিনি। সেগুলো হলো- আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়া, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, আমার আছে জল আর ঘেঁটুপুত্র কমলা।
দীর্ঘদিনের সাহিত্য জীবনে তিনি পেয়েছেন নানা পুরস্কার। তার মধ্যে রয়েছে সাহিত্যে-বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পদক, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, জয়নুল আবেদিন স্বর্ণপদক এবং চলচ্চিত্রে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার ইত্যাদি।
দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯ জুলাই, বৃহস্পতিবার ২০১২ তারিখে স্থানীয় সময় ১১টা ২০ মিনিটে নিউইয়র্কের বেলভিউ হসপিটালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি।
মৃত্যুর পরও তার জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি। দিনে দিনে তার জনপ্রিয়তা আরও বেড়েই চলছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে। হুমায়ূন আহমেদ তার সৃষ্টিকর্ম দিয়ে অমর হয়ে থাকবেন কোটি কোটি পাঠক হৃদয়ে।
এএম/এসএন