প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী কলেজ

১৮৮৪ সালে নির্মিত রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক ভবন
১৮৭৩ সালে রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী কলেজ এদেশের উচ্চশিক্ষার প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠগুলোর অন্যতম। কেবল ঢাকা কলেজ (১৮৪১) ও চট্টগ্রাম কলেজ (১৮৬৯) এর আগে প্রতিষ্ঠা হলেও এই দেশে মাস্টার্স কোর্স চালু হয় আগে রাজশাহী কলেজেই, ১৮৯১ সালে। কাজেই উচ্চশিক্ষার জন্য রাজশাহী কলেজই এই দেশের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান।
সুফি সাধক শাহ মখদুম রুপোশের দরগাহে গচ্ছিত নথিপত্র থেকে জানা যায়, একটি নগরী হিসেবে রাজশাহীর গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৬৩৪ সালে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে হল্যান্ড থেকে আসা বণিকেরা এখানে একটি ঘাঁটি গাড়ে। তাদের মাধ্যমেই এই অঞ্চলে ইউরোপীয়দের আগমন আরম্ভ হয়। ১৭৮১ সালে এই ডাচ বণিকেরা পদ্মা নদীর পাড়ে একটি রেশম কারখানা ও নীল ব্যবসার জন্য একটি কুঠি স্থাপন করে। সেই কুঠিবাড়ী বড়কুঠি নামে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই ভবনটিতেই ১৯৫৩ সালে স্থাপিত হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। নীলের ব্যবসা বহু বছর আগে বন্ধ হয়ে গেলেও রাজশাহীর রেশমশিল্প এখনো এই দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ। এ কারণেই এই শহর রাজশাহী নাম ছাড়াও শিক্ষার শহর ও সিল্কসিটি নামেও পরিচিত।
রাজশাহী কলেজের ইতিহাস ঘাটতে গেলে আসবে একটি স্কুলের নাম। ১৮২৮ সালে এই শহরের শিক্ষানুরাগীদের প্রচেষ্টায় বোয়ালিয়া ইংলিশ স্কুল নামে একটি প্রাইভেট ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল স্থাপন করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক সরকার স্কুলটি ১৮৩৬ সালে অধিগ্রহণ করে। সেই সময় দেশব্যাপী যত স্কুল সরকার অধিগ্রহণ করেছিল বা প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেগুলো সংশ্লিষ্ট জেলার নামে জেলা স্কুল নামেই নামকরণ করা হতো। কিন্তু রাজশাহী জেলার শিক্ষানুরাগীদের দাবির মুখে এবং স্কুলটির অদূর ভবিষ্যতে উন্নীতকরণের সম্ভাবনা বিচারে এটির নাম দেওয়া হয় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল।
উন্নীতকরণের এই দাবি সফল হতে লেগে যায় প্রায় চারটি দশক। ১৮৭৩ সালে স্কুলটি একটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের মর্যাদা পায়। ১৮৭৮ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গ্রাজুয়েশন কোর্স চালু করার মাধ্যমে এটি একটি “ফার্স্ট গ্রেড র্যাঙ্ক” কলেজে উন্নীত হয়। এই সময়ে এটি রাজশাহী কলেজ নাম ধারণ করে। কলেজিয়েট স্কুলের কিছু অব্যবহৃত জমি এবং পার্শ্ববর্তী জঙ্গল পরিষ্কার করে পদ্মা নদীর পাড় পর্যন্ত বিশাল এলাকা নিয়ে স্থাপিত হয় কলেজ ক্যাম্পাস।
কলেজের জীববিজ্ঞান ভবন
শিক্ষানুরাগীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নাটোরের দীঘাপতিয়ার মহারাজা প্রমথনাথ রায়, দুবলহাটির জমিদার হরনাথ রায় চৌধুরী, পুঠিয়ার রানী শরৎসুন্দরী ও হেমন্তকুমারী, নাটোরের জমিদার ও তৎকালীন বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের ডেপুটি স্পিকার ব্যারিস্টার আশরাফ আলী খান চৌধুরী প্রমুখ। দীঘাপতিয়ার মহারাজা কলেজটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রশাসনকে ১,৫০,০০০ রুপি প্রদান করেছিলেন, যার মধ্যে বিশেষ কিছু শর্ত সাপেক্ষে ২০টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করার জন্য দিয়েছিলেন ২০,০০০ রুপি। আশরাফ আলী খান চৌধুরী তার রাজশাহী শহরের বাড়ি চৌধুরী লজ-এ ২০ জন দরিদ্র মেধাবী মুসলিম ছাত্রের বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করতেন তাদের পৃথক হোস্টেল না হওয়া পর্যন্ত। কলেজটির প্রতিষ্ঠা ও প্রথম কয়েক দশকে উন্নতির পেছনে এসব মানুষের অবদান অনস্বীকার্য।
অনার্স প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের গ্রাজুয়েশনের পর ১৮৮১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে মাস্টার্স অব আর্টস (এমএ) কোর্স চালু করা হয় রাজশাহী কলেজে। দুই বছর পর আরম্ভ হয় ব্যাচেলর অব ল’। দীর্ঘ ১০ বছর পর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী কলেজের এই এমএ কোর্সকে স্বীকৃতি দান করলে কার্যতভাবে এই কোর্স চালু হয়ে যায়। তবে ১৯০৯ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন কিছু বিধি-নিষেধ প্রণয়ন করার পর বিএল ও মাস্টার্স কোর্স বন্ধ করে দিতে হয়। এর ফলে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হওয়ার আগ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় যেকোনো ধরনের মাস্টার্স কোর্স প্রায় ১২ বছর ধরে বন্ধ ছিল।
রাজশাহী কলেজের বিশাল ক্যাম্পাসটি নতুন ও পুরাতন স্থাপনার সমন্বয়ে গঠিত একটি দর্শনীয় ক্যাম্পাস। এর প্রাচীনতম ভবন ছিল পার্শ্ববর্তী কলেজিয়েট স্কুলের একটি পুরাতন অডিটোরিয়াম, যাতে বেঞ্চ বসিয়ে কলেজের লেকচার গ্যালারিতে পরিণত করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এটি কলা ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হলেও অন্য ভবনগুলো স্থাপনের পর এটি হয় রসায়ন ভবন। ১৯৯০ এর দশক পর্যন্তও কলেজের রসায়ন ভবন হিসেবে এটিই ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যবহারের একেবারেই অনুপযুক্ত এবং মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় সেটি ভেঙে পরে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন রসায়ন ভবন।
কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হরগোবিন্দ সেন প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রথম পাঁচ বছর। ১৮৮৪ সালে নির্মাণ হয় কলেজের প্রশাসনিক ভবন। ১৮৯৭ সালে অধ্যক্ষ হয়ে আসেন রায় কুমুদিনী কান্ত ব্যানার্জি বাহাদুর নামে একজন প্রখ্যাত শিক্ষানুরাগী। তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার সময়ে গড়ে তোলা হয় পদার্থবিদ্যা ভবন, জীববিজ্ঞান ভবন, একটি লাইব্রেরি হাজী মহসিন ভবন নামে একটি পৃথক লেকচার গ্যালারি কমপ্লেক্স, ফুলার হোস্টেল নামে ছাত্রাবাস এবং প্রশাসনিক ভবন ও জীববিজ্ঞান ভবনের মাঝখানে একটি চতুষ্কোনাকার বড় পুকুরসহ বোটানিক্যাল গার্ডেন। এই গার্ডেনে প্রচুর দুর্লভ গাছ রোপণ করা হয়। কলেজের বিশাল মাঠ পেরিয়ে পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষে গড়া হয় অধ্যক্ষের বাসভবন।
ফুলার ভবন
“সুস্থ দেহে সুস্থ মন” এই নীতির অনুসারী এই অধ্যক্ষ হাজী মহসিন ভবনে স্থাপন করেছিলেন কলেজ জিমন্যাশিয়াম। প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষকদের জন্য নির্মাণ করা হয় টেনিস কোর্ট। আর ছাত্রদের জন্য জীববিজ্ঞান ভবনের সামনে বানানো হয় ৪টি টেনিস কোর্ট। কলেজের পাশে আরও জমি অধিগ্রহণ করে গড়া হয় মুসলিম হোস্টেল ও হিন্দু হোস্টেল। তার সময়েই ফুলার হোস্টেল থেকে ছাত্রদের ধর্ম অনুযায়ী যার যার হোস্টেলে সরিয়ে সেখানে স্থানান্তর করা হয় কলা ও বাণিজ্য বিভাগ।
এরপর বিভিন্ন সময়ে কলেজের অডিটোরিয়াম ও শিক্ষকদের বাসভবন ছাড়াও নতুন আরও বেশ কিছু শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, বেশ কিছু ভবনের সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা অন্দোলনের সময় দেশের দ্বিতীয় শহীদ মিনারটি স্থাপন হয় রাজশাহী কলেজেই (যদিও দাবি করা হয় এটিই দেশের প্রথম)। সম্প্রতি মূল শহীদ মিনার ঘিরে এটিকে পুননির্মাণ করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালের পর রাজশাহী কলেজের স্বীকৃতি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর এর অধীনে আবার পূনন্যস্ত হয়। ১৯৯৩ সালে আবার মাস্টার্স কোর্স চালু করার মাধ্যমে রাজশাহী কলেজকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত করা হয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে এটি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে।
একটি চমকপ্রদ গল্প, যা না বললেই নয়
১৮৭৮ সালে যে ২০টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছিল, তার অন্যতম দুটি বিভাগ ছিল সংস্কৃত ও উর্দু। তবে ১৯৬০ এর দশক থেকেই সংস্কৃত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে উর্দু বিভাগে অনার্সের ছাত্র সংখ্যা কমতে থাকে। শিক্ষক সংখ্যাও কমতে কমতে দুটি বিভাগে বাকি থাকে কেবল একজন করে শিক্ষক। ১৯৭৪ সালের পর এই দুই বিভাগে কোনো ছাত্র-ছাত্রী আর ভর্তি হচ্ছিলই না। এদিকে ৭০ এর দশকের শেষ ভাগে এসে বাংলা বিভাগে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হলো প্রচুর, কিন্তু এই বিভাগে ছিল শিক্ষক সংকট। ঠিক এমন সময়ে ঘটে গেল এক চমকপ্রদ ঘটনা।
প্রশাসনিক ভবনের একতলায় ছিল শিক্ষক ও ছাত্রীদের কমনরুম (এগুলি এখন দোতলায় স্থানান্তর করা হয়েছে এবং প্রশাসনিক দপ্তর দোতলা থেকে একতলায় নিয়ে আসা হয়েছে)। অনার্স কোর্স ছাড়াও একাদশ ও দ্বাদশ বর্ষে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য মিলিয়ে কলেজে প্রায় ২,০০০ ছাত্র-ছাত্রী। শিক্ষকরা ক্লাস নিয়ে এসে হাঁপাতে থাকতেন। পরের ক্লাসের সময় হলে দল বেঁধে শিক্ষকরা বেরিয়ে যেতেন যার যার ক্লাসের জন্য নানা ভবনের উদ্দেশে। এরকম একটি সময় দেখা যাচ্ছিল দুইজন শিক্ষক প্রতিদিন কমনরুমের একটি কোনায় একটি টেবিল দখল করে সারাদিন ধরে দাবা খেলছেন। সকালে ঠিক সময়মতো হাজিরা দিয়েই বসে যান তারা দাবা খেলতে।দুপুরের খাওয়ার সময় খাওয়া সেরে আবার বসেন দাবা খেলতে। বিকেলে সবার সঙ্গে উনারাও বেরিয়ে যান। এই দুজন ছিলেন সংস্কৃত ও উর্দু বিভাগের শিক্ষক, যাদের বিভাগে একটিও ছাত্র নেই। সবাই যখন ব্যস্ত, তাদের নির্লিপ্ততা একদিকে যেমন ছিল দৃষ্টিকটু, আবার বাকি সব শিক্ষকের জন্যেই বিরক্তিকর পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এদিকে বাংলা বিভাগে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে অতিরিক্ত লোড নিতে গিয়ে সেই বিভাগের শিক্ষকরা পর্যুদস্ত। তারা কলেজ প্রশাসনকে অনুরোধ করলেন, এই দুজন শিক্ষককে বাংলা বিভাগে সংযুক্ত করার জন্য।
পদ্মার ধার ঘেঁষে নির্মিত কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবন
যেহেতু বিগত বছরগুলিতে এই দুই বিভাগে কোনো ছাত্রছাত্রী ভর্তিই হয়নি, কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এই দুটি বিভাগকে বিলুপ্ত করে শিক্ষক দুজনকে বাংলা বিভাগে স্থানান্তর করার একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এদিকে হঠাৎ দাবা খেলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে দুই দাবাড়ু শিক্ষক পড়লেন বিপাকে। তারাও এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার জন্য পথ খুঁজতে লাগলেন।
বিভাগ দুটি কবে থেকে আরম্ভ হয়েছে, কতজন শিক্ষার্থী ছিল, ইত্যাদি তথ্য খুঁজে বের করার জন্য দুই শিক্ষক যার যার বিভাগের পুরোনো ফাইল ঘাটতে ঘাটতে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পেয়ে গেলেন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। দুই বিভাগে একই দলিলের অনুলিপি, কিন্তু দুটিই অরিজিনাল স্ট্যাম্প কাগজে লেখা ও স্বাক্ষর করা। দলিলটি ১৮৭৮ সালের, স্বাক্ষর করা আছে দীঘাপতিয়ার মহারাজা প্রমথনাথ রায়ের ও কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষের। সাক্ষী ছিলেন প্রাদেশিক সরকারের একজন কর্মকর্তা।
দলিলে বলা হচ্ছে এই, যে মহারাজা বর্ণিত ২০টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করার জন্য ২০,০০০ রুপি দিচ্ছেন। প্রতিটি বিভাগের জন্য দলিলের যে কপি, তাতে শুধু সংশ্লিষ্ট বিভাগের নামটি আন্ডারলাইন করা। যাইহোক, টাকা দেওয়ার শর্ত হচ্ছে, এই কলেজ যতদিন চলবে, ততদিন অন্য নতুন বিভাগ বাড়ানো বা কমানো যাবে, কিন্তু বর্ণিত ২০টি বিভাগের কোনোটিই কখনই বন্ধ করা যাবে না। যদি এই শর্তের ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে যে সময়ে বন্ধ করা হচ্ছে, সেই সময়টিতে ১৮৭৮ সালের ২০,০০০ রুপির মূদ্রাস্ফীতি হওয়ার পর মূল্য যা দাঁড়াবে, তাকে মূলধন হিসেব করে প্রতি বছর ৬ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে মোট যত টাকা হয়, সে পরিমাণ অর্থ কলেজ কর্তৃপক্ষ মহারাজার কোনো বৈধ উত্তরসূরিকে দিতে বাধ্য থাকবে।
দলিল পেয়ে দুই দাবাড়ু আত্মহারা! কিন্তু টাকার হিসেব কীভাবে করতে হবে, তা তো জানা নেই। মহারাজার উত্তরসূরি কোথায় পাবেন, তাও জানা নেই। তাহলে উপায়?
দলিল রেখে দিলেন যার যার ফাইলে। দুজনে মিলে গেলেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষকের কাছে। গিয়ে বললেন, তাদের দুজনের মধ্যে একটি বাজি হয়েছে, কিন্তু সমাধান দিতে পারবেন কেবল অর্থনীতির অধ্যাপক। বাজি হলো, ১০০ বছর আগে ১০,০০০ টাকার বর্তমান অর্থনৈতিক মূল্য কত? অর্থনীতির অধ্যাপক বেশ মজা পেলেন। তিনি বললেন এই সমাধান তো হুট করে দেওয়া যাবে না। নানা ভাবে নানা বিষয় মাথায় নিয়ে হিসাব করতে হবে। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। এক সপ্তাহ সময় চেয়ে নিয়ে রাজি হলেন তিনি, কারণ বিষয়টি তাকেও বেশ প্রভাবিত করেছে। এরপর তারা গেলেন গণিতের এক প্রভাষকের কাছে। বললেন তারা তো আর গণিত বুঝেন না। ১,০০০ টাকার ৬ শতাংশ সাধারণ সুদে আর ৬ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হার সুদে ১০০ বছরে কতটা তফাৎ হয়? ক্লাস ছিল বলে গণিতের শিক্ষকের উঠতে হলো, তবে পরদিনই সমাধান করে দেবেন বলে কথা দিলেন। এরপর তারা গেলেন বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে। কিউরেটারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরিচয় দিলেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষক হিসেবে। জানালেন কলেজের তো ১০০ বছর পূর্তি হয়ে গেছে, কিন্তু বড় করে কোনো আয়োজন হয়নি। কী কী অনুষ্ঠান করা যায় এগুলি নিয়ে চিন্তা ভাবনা আরম্ভ হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে কলেজের স্থপতিদের বংশধরদের নিমন্ত্রণ করার চিন্তা হচ্ছে। দীঘাপতিয়ার মহারাজা প্রমথনাথ রায়ের উত্তরসুরীদের কাউকে পাওয়া গেলে খুব উপকার হয়। কিউরেটর নিজেও রাজশাহী কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। কিছুদিন সময় চাইলেন।
কলেজের শহীদ মিনার। সম্প্রসারণের সময় মূল মিনারটি অক্ষত রাখা হয়েছে
মাস দুয়েকের মধ্যে খোঁজ পাওয়া গেল চারজন নিশ্চিত উত্তরসূরির, যার তিনজন আছেন ইংল্যান্ড বা আমেরিকায়, একজন কোলকাতায়। একটি ছোট কোম্পানিতে অ্যাডমিন অফিসার হিসেবে কাজ করছেন এই ভদ্রলোক। ইতোমধ্যে অর্থনীতির অধ্যাপকের কাছ থেকে তারা মূলধনের হিসাব পেয়েছেন। গণিতের শিক্ষকের কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধির হিসাব বুঝেছেন। ব্যাংক থেকে জেনেছেন রুপি আর টাকার হিসেবের পার্থক্য। বাকি রইল ঐকিক নিয়মে হিসাব বের করা। হিসাব দাঁড়ালো প্রায় ১২ কোটি টাকা!
কোলকাতার ওই ভদ্রলোকের ঠিকানায় একটি চিঠি লিখলেন তারা সঠিক পরিচয় দিয়েই। জানালেন, তিনি যদি সত্যিই দীঘাপতিয়ার মহারাজা প্রমথনাথ রায়ের বংশধর হয়ে থাকেন, তাহলে বাংলাদেশি টাকায় তার প্রায় ১২ কোটি টাকা পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সাকসেশনের দালিলিক প্রমাণ থাকতে হবে। প্রমাণসহ তিনি যেন রাজশাহীতে সত্বর এসে তাদের সঙ্গে দেখা করেন। তবে অনেক টাকার ব্যাপার, তাই বিষয়টি গোপনীয় রাখা প্রয়োজন। এসে আর কাউকে যেন তিনি না বলেন।
কোলকাতার ভদ্রলোক আইনি কাগজপত্র বের করলেন। পাসপোর্ট ভিসা করে চলে এলেন রাজশাহী। দেখা করলেন দুই দাবাড়ু শিক্ষকের সঙ্গে। দুই শিক্ষক ডিপার্টমেন্টের ফাইল থেকে সেই দলিল বের করলেন। এই ভদ্রলোককে নিয়ে গেলেন রাজশাহীর একজন প্রখ্যাত উকিলের কাছে। প্রথমে দেখালেন পুরোনো দলিল। উকিল দেখে বিস্মিত হলেও বললেন দলিল ঠিক আছে। এরপর দেখালেন কোলকাতার ভদ্রলোকের সাকসেশনের দলিল। উকিল আবার সায় দিলেন যে ঠিক আছে। তার অর্থ যে দাঁড়ালো, এই লোকই পাবে সেই অর্থ, উকিল তা নিশ্চিত জানিয়ে দিলেন। ক্যাল্কুলেশন করে কত হবে, তা আর উকিলকে তারা জানালেন না।
ভদ্রলোককে নিয়ে এবার তারা দুজন এলেন কলেজে। অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করে ভদ্রলোককে পরিচয় করালেন প্রমথনাথ রায়ের বংশধর হিসেবে। আগের অধ্যক্ষ বদলি হয়ে চলে গেছেন। নতুন অধ্যক্ষ খুবই আনন্দিত হলেন কোলকাতা থেকে বেড়াতে আসা ভদ্রলোককে পেয়ে। এরপর তারা বের করলেন দলিল।
দলিল পড়ে অধ্যক্ষ থ’ মেরে গেলেন! তারা জানালেন, এই দুটি বিভাগ বন্ধ করে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাতে এই ভদ্রলোককে কলেজ প্রশাসনের ১২ কোটি টাকা দিতে হবে। অধ্যক্ষ জানতে চাইলেন হিসাব কে করেছে? তারা অর্থনীতির অধ্যাপক, গণিতের প্রভাষক এবং সোনালী ব্যাংকের কথা জানালেন। অধ্যক্ষ জানালেন উনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। কোলকাতার ভদ্রলোক মহাখুশি, দুজনের সঙ্গে বের হয়ে গেলেন।
ছাত্র-ছাত্রী কম, এমন অন্য তিনটি বিভাগের অধ্যাপকদের জরুরিভাবে ডাকলেন অধ্যক্ষ। ফাইলটি দেখিয়ে বললেন, ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে পুরোনো কাগজের যে ফাইল, সেটি থেকে খুঁজে বের করতে হবে এই দলিল। কালকেই ওনার দরকার। ওই দুই বিভাগ ছাড়াও আর অন্তত একটি বিভাগ থেকে ফাইলের কপি দরকার। তাহলে এটি যে মিথ্যে নয়, তা প্রমাণিত হবে। রাতে অধ্যক্ষ ফোন করলেন পুরোনো অধ্যক্ষকে, শলাপরামর্শ হলো। পরদিন দুপুরের মধ্যেই দুটি বিভাগ থেকে পাওয়া গেল দলিল। বিকেলে একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভা ডাকা হলো।
অধ্যক্ষ সবাইকে দলিল দেখালেন। মূল সারমর্ম পড়া হলো। কোলকাতার ভদ্রলোকের পরিচিতির প্রমাণ দলিল দেখানো হলো। হিসাব জানানো হলো। পাঁচ মিনিটেই মিটিং শেষ হলো এই সিদ্ধান্ত নিয়ে, বিভাগ দুটি বন্ধ করা যাবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেও চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে।
দুই দাবাড়ূ তো সভাতে ছিলেনই। তারা বড়ই উৎফুল্ল হলেন। অধ্যক্ষ তাদের জানিয়ে দিলেন, বিভাগ বন্ধ হচ্ছে না, তবে ছাত্র না থাকায় দুই শিক্ষককে বাংলা বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে, দিনে অন্তত একটি করে ক্লাস তাদের নিতেই হবে। তাতেই তারা খুশি, বাকি দিন তো দাবা খেলা যাবে!
কোলকাতার ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, “দাদা, আমার টাকা?” তারা জানালেন, কলেজ যদি সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে, তাহলে তো আর তাদের কিছু করার নেই। বিফল হয়ে ভদ্রলোক ফিরলেন কোলকাতায়। দুই দাবাড়ু পরদিন আবার বসলেন দাবার গুটি নিয়ে।
বি. দ্র.
আমি এই কলেজটির একজন গর্বিত ছাত্র। তবে আমাদের পরিবারে শুধু আমি নই, তিন প্রজন্মের বেশ কয়েকজন পড়ালেখা করেছি এই রাজশাহী কলেজে। আমার মা এই কলেজ থেকে গ্রাডুয়েশন করেছেন। আমরা সব ভাইবোন এই প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পাস করেছি। আমার বাবা তার চাকরিজীবন আরম্ভ করেছিলেন এখানে ১৯৫২ সালে। বহু বছর পরে তিনি ছিলেন এই কলেজের ৩৭তম অধ্যক্ষ। গল্পটি তার কাছেই শোনা।
সে সময়ে মিডিয়ার দৌরাত্ম্য ছিল না। যেকোনো খবরের লাইভ টেলিকাস্ট হতো না। ফেসবুক ছিল না। কলেজ প্রশাসন তাদের ও শিক্ষক দুজনের সম্মান রক্ষার্থে খবরটি প্রচার করেনি। তা না হলে হয়তো এই ঘটনা নিয়ে “কিস্তিমাৎ” বা “দাবাড়ু” নামে নাটকের পর নাটক হয়ে যেত চ্যানেলে চ্যানেলে!
ভ্রমণ যখন বা যেখানেই করি না কেন, পরিবেশের পরিচ্ছন্নতার দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সবাই যে করে, তা নয়। তবে কেউ কেউ যে করে, তা এই কলেজ চত্বরটিতে গেলে চোখে পড়ে। আপনার পরবর্তী প্রজন্মের ভ্রমণ পীপাসুদের জন্য হলেও আপনার ব্যবহৃত জিনিস নির্ধারিত জায়গায় ফেলুন বা সঙ্গে করে নিয়ে আসুন।
এসএন
