খেলারাম দাতার কোঠা
খেলারাম দাতার কোঠা
ঢাকার কাছাকাছি যতগুলি প্রত্নতত্ত্ব ভবনের দেখা মিলে, তাদের মধ্যে একইসঙ্গে দৃষ্টিনন্দন, চমকপ্রদ ও কৌতুহল উদ্দীপক স্থাপনা বলতে গেলে নবাবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত খেলারাম দাতার কোঠার কথা মাথায় আসে। দ্বিতল ভবনটি আনুমানিক ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কয়েক বছর আগে এটিকে সংস্কার করেছে। তবে এতে পরিচিতিমূলক কোনো তথ্য না থাকায় এর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতে পারেন না দর্শনার্থীরা।
দুর্গ, মন্দির, বাসভবন... একেকজনের একেক মত
ভবনটি কী মন্দির নাকি আখড়া? নাকি আবাসিক ভবন? এ নিয়ে যেমন মতবিরোধ রয়েছে, তেমনই মতবিরোধ রয়েছে ভবনটির নির্মাতা খেলারামের পুরো নাম নিয়ে। আবার সেই একই রকমের মতবিরোধ রয়েছে তার পরিচয় ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে।
কে ছিলেন খেলারাম?
বাংলাপিডিয়ার মতে তার নাম ছিল খেলারাম দত্ত বা খেলারাম দাদা। তিনি ছিলেন জমিদার। কিন্তু বিভিন্ন গবেষকের বিভিন্ন বইতে বাংলার জমিদারদের যত নামের তালিকা পাওয়া যায়, তার কোনো তালিকাতেই খেলারামের নাম নেই।
কয়েক বছর আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটি সংস্কার করেছে
স্থানীয় লোকজনের মতে তার নাম ছিল খেলারাম দাতা। উইকিপিডিয়া বা নবাবগঞ্জ উপজেলার সরকারি ওয়েবসাইটেও তার নাম খেলারাম দাতা হিসেবেই বলা হয়েছে। তাকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, বলা যায় তিনি ছিলেন বাংলার রবিন হুড।
উইকিপিডিয়ায় বলা হয়, তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দার। তবে ডাকাতি করে পাওয়া ধন সম্পদ নিজে ভোগ না করে দরিদ্রদের মাঝেই বিলিয়ে দিতেন। এই কারণেই স্থানীয়ভাবে তিনি দাতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন বেশি। শেষ বয়সে তিনি ধর্মকর্মে আসক্ত হয়ে পড়েন। তখন এই মন্দির নির্মাণ করেন। কিন্তু সরকারি ওয়েবসাইটে যা তথ্য দেওয়া আছে, তাকে সময়ের বিচারে এবং ভবনটির কাঠামোর সঙ্গে মেলানো প্রায় অসম্ভব।
সরকারি ওয়েবসাইটে বলা হয়, ওড়িশা (তৎকালীন উড়িষ্যা) থেকে আনুমানিক ৫০০ বছর আগে তিনি এখানে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। এলাকা পরিষ্কার করে জনবসতি গড়ে তুলেছিলেন। তাদের মতে এটি একটি দূর্গ। কিন্তু বাড়ির নির্মাণকৌশল ও কাঠামো অনুযায়ী বাড়িটি ১০০-১৫০ বছরের বেশি পুরোনো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া দূর্গের কোনো কাঠামোতেও এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
ভবনের বাইরের দেয়ালে ডিজাইন ডিটেইল
বাড়ির কাঠামো:
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কয়েক বছর আগে বাড়িটি সংস্কার করেছে। উইকিপিডিয়ার মতে এটি ছিল বিগ্রহ মন্দির। এর প্রথম তলায় দেখার মতো খুব বেশি কিছু নেই। ফাঁকা ঘরগুলির অনেকাংশই মাটির নিচে দেবে থাকার ফলে প্রায় সব বন্ধই থাকে। দোতলায় রয়েছে মাঝখানে একটি বড় অষ্টভূজাকৃতির ঘর। এর চারিদিকে রয়েছে ৮টি ছোট ঘর। আকারে সবগুলি ঘর সমান হলেও চার ধারের ঘরগুলির চাইতে চার কোণার ঘরগুলি তুলনামূলক ভাবে উচ্চতায় খানিকটা নিচু। প্রতিটির ছাদ চতুর্ভূজাকার হলেও সরু হয়ে উপরে এক বিন্দুতে মিলেছে।
মাঝখানের ঘরের ছাদটি অষ্টভূজাকৃতির, ঘরের ভেতরে চারিদিকে রয়েছে বেশ নিখুঁত দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ। পুরো ছাদটির গোড়ার অংশ ঘুরে রয়েছে সিমেন্টে খোদাই করা একটি সারি। দরজার উপরিভাগ থেকে এই সারির সামান্য নিচ পর্যন্ত চার ধারে রয়েছে চতুর্ভূজাকার নকশা আর চার কোণে রয়েছে খিলান আকারের নকশা। চতুর্ভূজাকার নকশাগুলির মধ্যে কিছুটা মিল থাকলেও খিলানাকৃতির নকশাগুলি একেকটি অন্যটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সংস্কারের সময় এই নকশাগুলি ঠিক রাখার প্রয়াসটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবে এগুলিকে রঙ করতে গিয়ে কিছু কিছু জায়গায় রং কিছুটা ছড়িয়ে গেছে। আরেকটু সচেতন হলে ভালো হতো। তবে বিস্মিত হয়েছি বেড়াতে আসা কিছু অসচেতন মানুষের কাণ্ড দেখে। রঙ করা দেয়ালে এত উঁচুতে উঠে কীভাবে যে মানুষ তাদের নাম লিখতে পারে, ভেবেই পাইনি!
দ্বিতল ভবনটির প্রতিটি ঘরই একেবারে ফাঁকা
একটি ছিল স্নানঘর, যাতে রয়েছে একটি চৌবাচ্চা। এটি নিয়ে গল্প আছে, যা পরে বলছি। নিচ তলার ঘরের একটিতে রয়েছে একটি সিঁড়ি, আরও নিচে নামবার জন্য। এখন সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এই সিঁড়িটির কারণেও বেশ কিছু গল্প শোনা যায়। একটি মত হলো, এটি ছিল একটি সুড়ঙ্গ, যে পথে খেলারাম পার্শ্ববর্তী ইছামতি নদীর ঘাট পর্যন্ত চলে যেতে পারতেন। তার ডাকাতির মাল নৌকা থেকে সরাসরি এই পথেই নিয়ে আসতে পারতেন। আবার কোনো বিপদ হলে এই পথেই তিনি পালিয়ে যেতে পারতেন নৌকায়। এই মতটি যে খুব অমূলক, তা বলা যাবে না। লালবাগ কেল্লাতেও এমন একটি সুড়ঙ্গ ছিল নদী পর্যন্ত যাবার। নরসিংদীর ইদ্রাকপুর দূর্গতেও ছিল এমন একটি সুড়ঙ্গ।
অন্য মতটি হয়তোবা গল্পই! কেউ কেউ বিশ্বাস করেন এটি ছিল একটি তিনতলা (কেউ বলেন পাঁচ তলা) বাড়ি, যার নিচের তলাগুলি মাটির নিচে দেবে গেছে। নিচতলার ঘরগুলি ছিল খেলারামের ধনসম্পদ লুকিয়ে রাখার গুদাম। এই সিঁড়ি ছিল সেই ঘরগুলিতে যাওয়ার জন্য।
মূল ভবনটির পাশে একটি অত্যন্ত নিখুঁত কারুকার্যখচিত দ্বিতল গোলাকার ছোট অবকাঠামো রয়েছে। উপরের তলা চারিদিকে খোলা। অনেকটুকু দেয়াল আবার চিনি-টিকরিতে মোড়া। স্থানীয়দের মতে, এটি ছিল খেলারামের ওয়াচ-টাওয়ার।
তবে গল্প যাই হোক, এটি মোঘল স্থাপত্য ও ইউরোপীয় স্থাপত্যের একটি চমৎকার সংমিশ্রণে নির্মাণ করা ভবন। একদিকে যেমন চুন-সুড়কির মিশ্রণে প্লাস্টারের কাজ করা হয়েছে, আবার লোহার বিমে ঢালাইয়ের কাজও রয়েছে। যে কারণেই এটিকে খুব বেশি পুরাতন ভাববার অবকাশ নেই। ৫০০ বছর তো নয়ই!
ভবনের পেছনের দেয়াল
ভবনটির অদূরেই রয়েছে একটি বড় পুকুর। কথিত আছে, খেলারাম এই পুকুরটি কাটিয়েছিলেন এলাকার মানুষের পানির জোগান দেওয়ার জন্য।
খেলারামের উপাখ্যান:
স্থাপনাটি দূর্গ, মন্দির, বিগ্রহ মন্দির, আখড়া বা আবাসিক ভবন যেটিই হোক না কেন, খেলারাম যে ডাকাতি করতেন এবং প্রাপ্ত সম্পদ দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দাতা হিসেবে সম্মানিত ছিলেন, এই স্বীকৃতি প্রায় সব তথ্যেই মেলে। তবে এর চাইতে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। এবার আসি স্থানীয়দের গল্পে। তাদের মতে ঘটনাটি প্রায় ২০০ বছর আগেকার।
খেলারাম দাতার ভবনটির কাছেই রয়েছে একটি পুকুর। এই পুকুরে সাধারণ মানুষ এসে কিছু চাইলে তা নাকি পূরণ হতো। স্নান করতে গিয়ে ডুব দিলেই হাতে উঠে আসতো মূল্যবান কিছু। তা হতে পারে স্বর্ণ, রৌপ্য বা হীরে-জহরত। কিন্তু দিনে যতবারই ডুব দিক না কেন, একবারের বেশি কেউ কিছু পেত না। যে কারণে পুকুরটিতে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হতো।
চিনি-টিকরির কাজে সজ্জিত ওয়াচ টাওয়ার
খেলারাম যত দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দারই হয়ে থাকুন না কেন, তিনি ছিলের ভীষণ রকমের মাতৃভক্ত। মা যা কিছু চাইতেন, বা যা কিছু আদেশ করতেন, অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন খেলারাম। তার মা প্রায়ই চাইতেন সবার সঙ্গে পুকুরে গিয়ে স্নান করতে। কিন্তু মায়ের এই একটি মাত্র বিষয়ে খেলারামের ঘোর আপত্তি ছিল। খেলারাম চাইতেন না সবার মাঝখানে তার মা পুকুরে নামুন আর ভেজা কাপড়ে বাসায় ফিরুন। এজন্য উপরের একটি ঘরে একটি চৌবাচ্চা বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই পুকুর থেকেই লোক দিয়ে কলস বা হাঁড়িতে করে প্রতিদিন নতুন করে পানি আনা হতো মায়ের স্নানের জন্য। মা এতে ভেসে ভেসে স্নান করতে পারতেন।
একদিন নাকি মা বলেছিলেন একটু বেশি করে দুধ আর পাকা কলা নিয়ে আসার জন্য। খেলারাম দুধ এনে স্নানঘরের চৌবাচ্চা ভরে ফেলেছিলেন। পাশে রেখে দিয়েছিলেন এক কাঁদি পাকা কলা, যেন মা দুধে ভেসে ভেসে স্নান করতে করতে কলা খেতে পারেন।
অষ্টভূজাকৃতি ছাদের একপাশে নকশা
মা একদিন টের পেলেন খেলারাম এলাকায় নতুন আসা এক ধনী লোকের বাসায় ডাকাতি করার পরিকল্পনা করেছেন। মা চাইলেন না প্রতিবেশীর বাড়িতে ছেলে ডাকাতি করুক। নিষেধ করে দিলেন তিনি এই ব্যাপারে। কিন্তু খেলারামের তর সইল না। ডাকাতি করতে গেলেন এক রাতে। বাড়ির লোকজন টের পেয়ে চেঁচামেচি আরম্ভ করায় একজনকে আঘাত করেন খেলারাম। সঙ্গে সঙ্গে ওই লোক মারা যান। সকালে ঘুম থেকে উঠে খবর পেয়ে যান মা। খেলারামকে ডেকে ভীষণ বকাঝকা করেন। খেলারাম কথা দেন সমস্ত ডাকাতি করা মাল ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন। কিন্তু যে লোকের প্রাণ গেল, তার পরিবারের কী হবে? খেলারাম বললেন তাদের অনেক ধন সম্পদ দিয়ে দেবেন। কিন্তু মা জানালেন, ধন সম্পদ দিলেও লোকটির প্রাণ তো ফেরানো যাবে না। অবাধ্য ছেলের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, পুকুরে যাবেন বলে। এই যে পুকুরে নেমে ডুব দিলেন, আর উঠে আসলেন না।
খেলারাম খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিলেন পুকুরে। সমস্ত লোক লাগিয়ে দিলেন। ডুব দিয়ে, জাল ফেলেও মাকে পাওয়া গেল না।
শত চেষ্টা স্বত্ত্বেও বিফল হয়ে খেলারাম যখন বাড়ি ফিরছেন, তাকিয়ে দেখলেন বাড়িটি ধীরে ধীরে দেবে যাচ্ছে মাটির নিচে। উল্টোমুখে ঘুরে দৌড় দিলেন খেলারাম। আর তাকে কোনোদিন কেউ ফিরতে দেখেনি।
দোতলায় ঘরগুলো একটি থেকে অন্যটি একেবারেই পৃথকভাবে নির্মিত
কেউ কেউ বিশ্বাস করে খেলারাম মায়ের মতোই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে গেছেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করে বাড়ির ভেতরের নিচের কোনো তলায় চাপা পড়ে গেছেন তিনি। এরপর বেশ কিছুদিন খালি পড়ে ছিল বাড়িটি। তারপর স্থানীয় লোকজন এসে লুটপাট করে বাড়ি খালি করে ফেলে।
এই গল্পটি স্থানীয়দের মুখে মুখেই শোনা যায়। বিশ্বাস করবেন? সরকারি ওয়েবসাইটেই যখন ৫০০ বছরের গপ্পো জুড়ে দেওয়া আছে, না হয় স্থানীয়দের গল্পটিই বিশ্বাস করুন!
কীভাবে যাবেন:
গুলিস্তান থেকে বাস পাওয়া যায় নবাবগঞ্জের। বাসস্ট্যান্ডে নেমে যেতে হবে কলাকোপার পথে। পথেই পড়বে। সিএনজি অটোরিকশা বা রিকশাতেও যাওয়া যায়।
এসএন