জন্মদিনে কামরুল হাসান শায়ক ঢাকাপ্রকাশকে বললেন
‘আগামী বইমেলা নিয়ে প্রকাশকরা মহাসংকটে’
কামরুল হাসান শায়ক বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে এক অবিসংবাদিত নাম। আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড দেশের প্রথম চেইন বুক স্টোর পিবিএস এবং বিশ্বমানের প্রিন্টিং প্যাকিজিং ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে প্রকাশনা শিল্পে তার অবদান বিস্ময়কর এবং অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে সমষ্টিগতভাবে বিশ্বমানে উন্নীত করে আন্তর্জাতিক প্রকাশনাপ্রবাহে সংযুক্ত করার লক্ষে তিনি প্রায় তিন দশক ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনে (আইপিএ) বাংলাদেশের স্থায়ী সদস্যপদ অর্জন এবং এশিয়া প্যাসেফিক পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনে বাংলাদেশের প্রকাশকদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন।
আজ ৬ সেপ্টেম্বর কামরুল হাসান শায়কের জন্মদিন। এ উপলক্ষে 'ঢাকাপ্রকাশ'-এর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় আগামী অমর একুশে বইমেলা নিয়ে তার ভাবনার কথা।
কামরুল হাসান শায়ক বলেন, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন ‘অমর একুশে বইমেলা’। প্রকাশক হিসেবে আমি অত্যন্ত গর্বিত যে, এই বইমেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল কয়েকজন প্রকাশক। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি ভাষার মাসে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। সেই সময় ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা মুক্তিযুদ্ধকালীন কোলকাতায় শরণার্থী লেখকদের (আবদুল গাফফার চৌধুরী, আনিসুজ্জামান প্রমুখ) মুক্তধারা কর্তৃক প্রকাশিত ৩২টি বই, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বই এবং বর্ণ মিছিল প্রকাশনীর তাজুল ইসলাম নিজেদের প্রকাশিত কিছু বই নিয়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে পাটের চট বিছিয়ে তাতে থরে থরে বই সাজিয়ে সর্বপ্রথম অমর একুশে বইমেলার সূচনা করেন।
১৯৭৪ সালে অমর একুশেকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে দেশি-বিদেশি প্রখ্যাত লেখক-শিল্পীদের অংশগ্রহণে স্বাধীন দেশে প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেই সম্মেলনের প্রধান অতিথি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন চিত্তরঞ্জন সাহা, রুহুল আমিন নিজামী এবং তাজুল ইসলাম ছাড়াও আরও সাত আট প্রকাশক বইমেলায় অংশগ্রহণ করেন। এই বইমেলা জনমনে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। ৭২ থেকে ৭৬ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এই বইমেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে, ক্রমশ মেলায় প্রকাশক, লেখক এবং পাঠকের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে প্রকাশকদের এই বইমেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন।
১৯৭৯ সালে বইমেলা সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য বাংলা একাডেমির সঙ্গে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি যুক্ত হয়। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মাওলা যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক তখন তিনি বাংলা একাডেমিতে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহযোগিতায় প্রথম আনুষ্ঠানিক 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'র আয়োজন করেন। কিন্তু উদ্বোধনের দিন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষাভবনের সামনে ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দু'জন ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় সে বছরের জন্য বইমেলা স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমির আয়োজনে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সার্বিক সহযোগিতায় সাড়ম্বরে 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা' শুরু হয়। এ বছর প্রায় ৩৩টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এই বইমেলায় অংশগ্রহণ করে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতিও 'অমর একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে সহযোগিতায় যুক্ত হয়। ১৯৮৪ থেকে ২০১৩ সালের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় 'অমর একুশে বইমেলা' লেখক, প্রকাশক এবং পাঠকের আশ্চর্য রসায়নে বাঙালির প্রাণের সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের পদভারে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের সীমিত পরিসরে বইমেলা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পরামর্শে ২০১৪ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলাকে সম্প্রসারিত করা হয়।
২০১৮ সালে 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেলার নাম পরিবর্তন করে বলেন, আজ থেকে 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'র নাম আরও সহজতর হবে 'অমর একুশে বইমেলা'।
আজ অমর একুশে বইমেলা বাঙালি জাতির মাসব্যাপি সাংস্কৃতিক উৎসবের এক মহামহীরুহে পরিণত হয়েছে। এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখক-প্রকাশক-পাঠক যেন ভাষার মাসে এক ঐক্যতানে জেগে ওঠে। বই কেনা এবং পড়ার সংস্কৃতি শ্বাশত বাঙালির গৌরবময় ঐতিহ্য— প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলা এই সাংস্কৃতিক বার্তাই যেন আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমর একুশে বইমেলার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, জ্ঞান চর্চা ও পাঠের বিস্তারে অমর একুশে বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। জাতির মনন গঠনে এই বইমেলা সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখে চলছে।
'অমর একুশে বইমেলা-২০২৩' নিয়ে আমরা প্রকাশকরা আছি মহাসংকটে। নতুন বই প্রকাশের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন অধিকাংশ প্রকাশকই। নতুন বই প্রকাশের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না তারা। কারণ, পর পর দু’বছর করোনার ছোবলে প্রকাশনা শিল্পের ভয়াবহ ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্যে কোনোরকম প্রণোদনা পায়নি তারা। উপরন্তু এ বছর প্রকাশনার সব কাঁচামালের দাম বেড়েছে প্রায় শতকরা পয়তাল্লিশ ভাগ। এমনতেই বইয়ের বিক্রি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, তার উপর বাড়তি দাম আরোপ হলে পাঠক তো আরও বইবিমুখ হবেন। পুরাতন বই রিপ্রিন্ট করলেও বইয়ের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। নিচে কিছু কাঁচামালের ২০২২ সালের জানুয়ারি এবং বর্তমান মূল্য তুলনা করলেই বিষয়টি খুব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন-
৩২" হোয়াইট প্রিন্ট ৭০ জিএসএম কাগজ জানুয়ারি'২২ এ প্রতি কেজির মূল্য ছিল ৯০ টাকা, বর্তমানে মূল্য ১৩০ টাকা।
৩০" হোয়াইট প্রিন্ট ৭০ জিএসএম কাগজ জানুয়ারি '২২ এ প্রতি কেজির মূল্য ছিল ৯০টাকা, বর্তমানে মূল্য ১৩০ টাকা।
১০০ গ্রাম অফসেট ডিডি কাগজ (লোকাল) এর জানুয়ারি '২২ এ প্রতি রিমের মূল্য ছিল ২৫৩০ টাকা, বর্তমানে মূল্য ৩৫২৫ টাকা।
প্রিন্টিং কালি ওয়েব জানুয়ারি '২২ এ প্রতি পাউন্ডের মূল্য ছিল ৭০ টাকা, বর্তমান মূল্য ১০৫ টাকা।
প্রিন্টিং কালি শিট জানুয়ারি '২২ এ প্রতি পাউন্ডের মূল্য ছিল ২৭৫ টাকা, বর্তমান মূল্য ৩১৫ টাকা।
প্রিন্টিং প্লেট ওয়েব ৮২০" ×৫৯০" জানুয়ারি '২২ এ প্রতিটির মূল্য ছিল ২৫২ টাকা, বর্তমান মূল্য ২৯৫ টাকা।
প্রিন্টিং প্লেট শিট ৬০৫" × ৭৬০" জানুয়ারি ২২ এ প্রতিটির মূল্য ছিল ১৬২ টাকা, বর্তমান মূল্য ২৩০ টাকা।
বাইন্ডিং গ্লু জানুয়ারি '২২ এ প্রতিকেজির দাম ছিল ৪২৫ টাকা, বর্তমান মূল্য ৪৫০ টাকা।
এ ছাড়াও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে গেছে। কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সামগ্রিক বিবেচনায় প্রকাশকদের পাশে এই মুহূর্তে সরকার যদি সদয় হয়ে বিশেষ বরাদ্দ ও অন্যান্য সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে না আসে তাহলে আসন্ন 'অমর একুশে বইমেলা'র মতো এমন একটি জাতীয় আয়োজনে নতুন বইয়ের প্রকাশ অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়বে, পুরাতন রিপ্রিন্ট বইয়ের দাম বাড়বে; এর ফলে আগামী বইমেলায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে। এ ব্যাপারে আশু পদক্ষেপ জরুরি।
সামগ্রিক বর্তমান চিত্র উপস্থাপনের পর নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন প্রস্তুতিটা প্রকাশকদের কেমন চলছে! তারপরও সফল 'অমর একুশে বইমেলা'র জন্য আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
আরএ/