সব বই বই নয়
বই নিয়ে আন্তর্জাতিক দিবস যে আছে, সেটি আমি এই প্রথম জানলাম। জেনে ভাল লাগলো এজন্যে, বই সংক্রান্ত মানুষের ভাবনা চিন্তা আছে। বই পড়ার দুটি গুণ আছে। একটি হচ্ছে মানসিক, আরেকটি হচ্ছে শারিরীক। মানসিক হচ্ছে, আমার কাছে যেটি মনে হয় যে, বই পড়া মানে মনের জানালা, দরজা খুলে যাওয়া। তবে মনে রাখতে হবে, বইয়ের মতো বই হতে হবে। সব বই বই নয়। যেমন জীবনানন্দ দাস বলেছেন, কেউ তো কবি, সবাই কবি নয়। কবিতা লিখলেই কবি হওয়া যায় না। কাজেই বই ছাপা হলেই তাকে বই বলা যাবে, এমন কথার কোন যুক্তি সংগত ভিত্তি নেই। যে বই আমাকে ভাবায়, যে বই আমাকে চিন্তা করতে শিখায়, যে বই আমার মনের জানালা দরজা খুলে দেয়, সেটি বই। চটুল চানাচুরের মত যেগুলি ছাপা হয় সেটি বই নয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক বই দিবসে আমি অন্তর্ভুক্ত করছি সেই বইগুলিকে, যে বইগুলি আমার বিবেচনায় বই।
বই পড়া নিয়ে অনেক কথা আছে। তবে একটি কথাই সবচেয়ে বড়। সেটি হচ্ছে, বই পড়ে মানুষ শিক্ষিত হয়। যেমন- আরজ আলী মাতাব্বর, যাকে বাংলাদেশে আমি একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি মনে করি এখন পর্যন্ত। সেই আরজ আলী মাতব্বর শিক্ষিত হয়েছিলেন বই পড়েই। আমরা বই পড়ি কেউ পরীক্ষা পাশের জন্য।কিন্তু আত্মস্থ করি না। গলাধঃকরণ করি তারপর উগড়ে দিই পরীক্ষার খাতায়। বই পড়া যে মানুষের জীবনের জন্য সেটি অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বিদ্যা সহজ, শিক্ষা কঠিন। বিদ্যা আহরণের, শিক্ষা আচরণের। বাংলাদেশে বিদ্যান অনেক মানুষ আছেন, অনেক লম্বা লম্বা সার্টিফিকেট আছে। কিন্তু তাঁরা শিক্ষিত কি না তা প্রকাশ পায় তাদের আচরণের মাধ্যমে। আমি চারটি বিষয় দিয়ে মানুষের মনুষত্ব্য গ্রহণযোগ্য কি না তা বিচার করি। প্রথমত আচরণ, দ্বিতীয়ত বচন, তৃতীয়ত বসন, চতুর্থত বিচরণ। মানুষ কিভাবে হাটবে, সেটি বিধাতা প্রদত্ত। তবুও হাঁটার মধ্যে শীলিতভাব আছে যা অনায়াসেই মানুষ নিজেই করতে পারে।
বইয়ের মানসিক উপকারিতার পাশাপাশি শারিরীক উপকারিতার কথা যদি বলি, একটি গবেষণা প্রতিবেদন, তাতে বলা হচ্ছে, যারা নিয়মিত বই পড়েন, তাদের মস্তিষ্ক সচল থাকে। সৃতিশক্তি ভাল থাকে। উপরন্তু, তাঁরা সাধারণত দীর্ঘায়ু হন। কাজেই বই পড়ার একটি মানসিক দিক এবং স্বাস্থ্যগত দিকও আছে বৈকি। আমি একটি গবেষণা বই পড়েছিলাম। এন্ড্রিনিউবার্গ ও জন্স ওয়ার্ল্ডম্যান দুজনেই মনোবিদ। তাদের বইয়ের শিরোনাম, ‘ওয়ার্ডস ক্যান চেঞ্জ ইউর ব্রেইন’। এটি শোনা কথা হতে পারে। বইয়ের অক্ষরও হতে পারে। আমি নিজের জীবনে দেখেছি, বই আমাকে এবং অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। বই আমাকে সাহস দেয়। ভীতি দেয় না। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো আত্মবিশ্বাস দেয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক বই দিবসের প্রতি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। বিশেষ করে লেখা পড়া জানা মানুষগুলি যেন বইমুখি হয়। সৈয়দ মুজতবা আলীর কথার মত, বাড়িতে তো একটি বই আছে। কাজেই বই কেনার দরকার নাই। এরকম যেন না হয়। মনে রাখতে হবে, বই কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না। মানুষ করতে পারে। সুতরাং বই আমার কাছে অকৃত্রিম সুহৃদ।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট