কাশফুলের শুভ্রতায় পালকি-দোলনার প্রেমে সুরঞ্জনা
'ফিরে এসো সুরঞ্জনা, নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে; ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে... তোমার হৃদয় আজ ঘাস, বাতাসের ওপারে বাতাস-আকাশের ওপারে আকাশ।'
কবি জীবনানন্দ দাশের আকাশলীনা কবিতার এই সুরঞ্জনা বাস্তবিক কিংবা কাল্পনিক হলেও বরগুনায় সন্ধান পাওয়া গেছে এমনই প্রাকৃতিক সুরঞ্জনার। যেখানে রয়েছে সবুজ অরণ্য ঘেরা বিস্তীর্ণ মাঠ, রয়েছে ঘাস, শরতের কাশফুল ও স্নিগ্ধ বাতাস। জোছনা রাতে প্রকৃতিতে এখানে সৌন্দর্যের আগুন লাগে।
ইকোট্যুরিজমের উন্নয়নের লক্ষে বরগুনায় সম্প্রতি তৈরি হয়েছে 'সুরঞ্জনা' নামে এমনই এক ইকোপার্ক। বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের বরইতলা সংলগ্ন বিষখালী ও খাকদোন নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা সুরঞ্জনা ইকোপার্কে রীতিমত দর্শনার্থীদের ভিড় জমতে শুরু করেছে।
ভরদুপুরে দূর থেকেও শোনা যায় এখানকার নানা প্রজাতির পাখপাখালির ডাক। পার্কের দুই দিকে সবুজ বনের বুক চিরে সাপের মতো একেবেঁকে কাঠের সড়ক চলে গিয়েছে বনের গহীনে। কাঠের সেই পথ ধরে বনের ভেতর হারিয়ে যাওয়া, প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে সত্যি অভাবনীয় এক অনুভূতি।
এখানে রয়েছে প্রাণ-প্রকৃতির অবাধ বিচরণ। ছৈলা, গোল পাতার গাছ, কেওড়াসহ নানা ধরনের বনজ বৃক্ষে ভরপুর দৃষ্টিনন্দন এই ইকোপার্কের মাঝখানে বসানো হয়েছে বিশালাকারের কুমির ও কাঁকড়ার অবয়ব। এ ছাড়াও রয়েছে বাঘ, সিংহ, হরিণ, বক, জিরাফ, কুমিরসহ বেশকিছু জীবজন্তুর অবয়ব।
শুধু অবয়বই নয় এখানে জল ও স্থলে রয়েছে নানা রকমের জীবন্ত প্রাণীর বাস। পাখি, শৃগাল, বেজি, কাঠবিড়ালি, গুইশাপ, কাঁকড়া, গিরগিটিসহ নানা প্রাণীর দেখা মিলবে এখানে। রয়েছে জঙ্গল বাড়ি, ক্যাফে, মটকা চায়ের দোকানও।
এ ছাড়াও মান্না দে'র বিখ্যাত সেই কফি হাউজ গানের নিখিলেশ, মইদুলসহ স্মরণীয় নামগুলোতে গড়া হয়েছে একাধিক ফ্যামিলি কটেজ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বহনকারী পালকি, দোলনাও রয়েছে এখানে। বসছে বায়স্কোপও।
যদিও পার্কটির নির্মাণকাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। তারপরও পার্কটিতে প্রবেশের পর নিখাঁদ প্রকৃতির আবেশে মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। কেউ ছবি তোলেন, কেউ মনের আনন্দে নৃত্য করেন, কেউবা আবার আবৃত্তি কিংবা আনমনে গেয়ে ওঠেন গান।
একবার এখানে আসা দর্শনার্থীরা শরতের নীল আকাশের নিচে দোলনায় দোল খেতে, বউ সেজে পালকিতে চড়তে কিংবা কাশফুলের স্নিগ্ধ স্পর্শের প্রেমে পড়ে হলেও বারবার এখানে ফিরে আসেন।
কথা হয় ভ্রমণ পিপাসু কয়েকজনে সঙ্গে। পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা আমিনুর রহমান বলেন, বরগুনায় বিনোদনের জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই নেই। পরিবার নিয়ে সময় কাটাতে মনোরম এমন একটি প্রাকৃতিক পরিবেশের দরকার ছিল।
কিশোরী জেরিন, মীম ও তাব্বাসুম বলেন, এ যেন একটুকরো সুন্দরবন। শহরের পাশে বসে এভাবে প্রকৃতিকে উপভোগ করার এতো সুন্দর যায়গা আর কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। গোধূলির সময় পালকিতে কিংবা দোলনায় দোল খেতে খেতে দোদুল্যমান সাদা কাশফুলগুলো দেখতে সত্যি মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।
কোস্টাল এনভারনমেন্ট প্রটেকশন নেটওয়ার্ক এর সমন্বয়ক রুদ্র রুহান বলেন, সৈকত সৌন্দর্যের জেলা বরগুনা। এখানে রয়েছে অসংখ্য জায়গা। এসবের সমন্বয় ঘটাতে পারলে এ জেলা হবে দক্ষিণাঞ্চলের ইকোট্যুরিজম জোন।
সুরঞ্জনা ইকোপার্কের উদ্যোক্তা সাংবাদিক ও আইনজীবী সোহেল হাফিজ বলেন, উপকূলীয় বরগুনা জেলার পরিচিতি বহন করতেই এই সুরঞ্জনার আয়োজন। এ জেলায় এমন দর্শনীয় অসংখ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে, তবে উদ্যোগের অভাবে জেলার ইকোটুরিজম বিকশিত হয় না।
বরগুনা-১ আসনের সাংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, পিছিয়ে পড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠী সুরঞ্জনা ইকো ট্যুরিজমের মাধ্যমে দ্রুতই উন্নয়নের পথে ধাবিত হবে। বরগুনায় এমন অসংখ্য দর্শনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় স্থান রয়েছে। এভাবেই অপার সম্ভাবনাময় বরগুনার ইকোট্যুরিজম একদিন এগিয়ে যাবে।
এসএন