ডীপসিক কী? যার অভিষেকে কাঁপছে প্রযুক্তি দুনিয়া
ডীপসিক। ছবি: সংগৃহীত
চীনা এআই চ্যাটবট ডিপসিক আর ১ উন্মোচনের পর রীতিমতো টালমাটাল প্রযুক্তি দুনিয়া। সম্প্রতি বাজারে নতুন সংস্করণ ছেড়ে প্রযুক্তি জগৎ কাঁপিয়ে দিয়েছে চীনা এআই ডিপসিক (DeepSeek)। ‘মেড ইন চায়না’র সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য দামে কম। ‘মানে ভালো’ সব ক্ষেত্রে বলা যায় না।
তবে ডিপসিক এই কদিনেই কাজেকর্মে প্রমাণ করেছে, এটি ভালোভাবেই পাল্লা দিতে এসেছে। গ্রাহককে তা-ই ভালো জিনিসই দিতে চাচ্ছে তারা। ওপেনএআইয়ের চেয়ে কাজে-কর্মে যে কোনোভাবেই কম যায় না, তা এটি দেখিয়েছে। গুগল এবং ওপেনএআইয়ের যোগ্য প্রতিদ্বন্ধী হিসেবেই এসেছে এটি।
কারা বানাল এই ডিপসিক এআই? এটি চীনের হ্যাংঝুনির্ভর একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং। ২০২৩ সালের শেষদিকে যাত্রা করে প্রতিষ্ঠানটি। ওয়েনফেংকে এতদিন চীনের বাইরে কেউ তেমন চিনত না বটে, তবে আগেও তিনি প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগ মিলিয়ে ভালো কারিশমা দেখিয়েছেন। হাই-ফ্লায়ার নামে একটি হেজফান্ডও সফলভাবে চালাচ্ছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে শুধু “কৌতূহল”-এর বশে পা রেখেছেন তিনি।’
‘বড় পরিসরে ভাবলে, আমরা শুধু একটা হাইপোথিসিস নিশ্চিত করতে চাই। যেমন ধরুন, আমাদের একটা হাইপোথিসিস হলো মানব বুদ্ধিমত্তার মূল সার তার ভাষা এবং মানুষের চিন্তাধারা একটি ভাষাগত প্রক্রিয়া বা লিঙ্গুইস্টিক প্রসেস,’ বলেছেন ওয়েনফেং। তাঁর মতে, আমরা যাকে ‘চিন্তা’ বলি, তা আসলে মস্তিষ্কের ভাষা বুনে চলা। তাঁর ধারণা, এজিআই তথা যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পুরোপুরি মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে, তার শিকড় রয়েছে এর ভেতরে। তিনি বলছেন, ‘এর ফলে হয়তো লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল থেকে এজিআই বা আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্সের সূচনা হতে পারে।’
ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যান বলছেন, ডিপসিক ‘ইম্প্রেসিভ’; তবে এ নিয়ে তাঁরা এখনো চিন্তিত নন। ভালো মডেলের পাশাপাশি উন্নত কম্পিউটিং সক্ষমতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। শিগগিরই তাঁরা আরও উন্নত মডেল বাজারে আনবেন। তিনি বলছেন, ‘এরকম ভালো প্রতিদ্বন্ধী থাকা তো বেশ!’
তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? বিষয়টা হলো, ডিপসিক নতুন এসে সাড়া ফেলেছে বটে, তবে এখনি তারা যুদ্ধটা জিতে যায়নি। এটা কেবল শুরু। আরও কিছুদিন পর বোঝা যাবে, ডিপসেক দীর্ঘযাত্রায় কত দূর যাবে। তবে অল্প সময়ে ডিপসেকের কাজ কিছুক্ষেত্রে যে চ্যাটজিপিটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তা; এর সঙ্গে অর্থনীতি, এনভিডিয়ার শেয়ারে ধস নামা বোঝাচ্ছে, প্রযুক্তির বাজারের শেষ কথা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিপসিকের উন্মোচনে যুক্তরাষ্ট্রের এআই শিল্পের উল্লম্ফন নিয়ে বিনিয়োগ আস্থা নড়ে গেছে। বিনিয়োগকারীরা চীনের এ আবিষ্কারের সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছেন। এরই প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারে। মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সূচক নাসডাক কম্পোজিট সোমবার ৩ দশমিক ১ শতাংশ কমে গেছে। গত সপ্তাহে এ সূচকের বাজারমূল্য ছিল ৩২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, সোমবার যা প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার কমে যায়।
এতে মার্কিন শেয়ারবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পতনের মুখে পড়ে বিশ্বের শীর্ষ এআই চিপ নির্মাতা এনভিডিয়া। শেয়ারদর ১৭ শতাংশ কমায় কোম্পানিটি বাজারমূল্য হারিয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার। একই সময়ে গুগলের প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের বাজারমূল্য ১০ হাজার কোটি ডলার ও মাইক্রোসফটের বাজারমূল্য ৭০০ কোটি ডলার কমে গেছে।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এই মডেলের পেছনের গবেষক দল জানিয়েছে, ৬০ লাখ ডলারের কম খরচ করেছে তারা এই এআইকে প্রশিক্ষণ দিতে। ওপেনএআই, মেটা এবং আলফাবেট (গুগল)-এর বিপুল অর্থের বিপরীতে এত অল্প খরচে ভালো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে চীন বুঝিয়ে দিল, তারা কোনোভাবেই কম যায় না।
বিষয়টার ভয়াবহতা বোঝা যায় দ্য কোবেইসি লেটারের প্রতিষ্ঠাতা ও বাজার বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম কোবেইসির এক্স-এ লেখা এক স্ট্যাটাস থেকে। ‘ওপেনএআই যাত্রা শুরু করেছিল প্রায় ১০ বছর আগে। সে সময় তাদের সাড়ে ৪ হাজার কর্মী ছিল। ফান্ডিং তুলেছিল তারা প্রায় ৬৬০ কোটি টাকার। আর ডিপসেক যাত্রা করেছে মাত্র ২ বছর আগে। তাদের কর্মী দুই শরও কম।’
সিলিকন ভ্যালির অন্যতম প্রভাবশালী ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট মার্ক অ্যান্ড্রিসেন। তাঁর একটি উক্তি জানা যাচ্ছে আল জাজিরার সূত্রে, ‘এটি এআইয়ের স্পুৎনিক কাল।’ মহাকাশ জয়ের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। সবার আগে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে তারা দেখিয়ে দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রই শেষ কথা নয়। ডিপসিক সবার আগে আসেনি বটে, কিন্তু গত কদিনেই চ্যাটজিপিটিকে পেছনে অ্যাপলের অ্যাপস্টোরে শীর্ষে উঠে গেছে এই এআই। বুঝতেই পারছেন, কী ঝড় বইয়ে দিয়েছে এই এআই।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহেই ঘোষণা দিয়েছেন, ওপেনএআই, একই দেশের ওরাকল এবং জাপানের সফটব্যাঙ্কের নেতৃত্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে দেশটি। সেই সঙ্গে এও বলেছেন, ‘এই যুদ্ধে জয়ের প্রতি তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে তাদের।’
এ যেন নতুন এক শীতল যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যে-ই জিতুক, গোটা বিশ্ব এবং মানুষের অগ্রগতি হবে, এমনটাই আশা প্রযুক্তিবিদদের।