শুক্রাণু-ডিম্বাণু ছাড়াই মানব ‘ভ্রূণ মডেল’ তৈরি করলেন ইসরায়েলের বিজ্ঞানীরা
ইসরায়েলি বিজ্ঞানীদের ব্যবহৃত স্টেম সেল থেকে উদ্ভূত ভ্রূণ (নীল), ডিম্ব থলি (হলুদ) এবং অমরা বা প্লাসেন্টা (গোলাপি)। ছবি: ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স
শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর নিষেকে ভ্রূণ (Embryo) তৈরি হয়। স্তন্যপায়ী প্রাণীর বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম এটাই। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে চলছে প্রাণের প্রবাহ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তো বিজ্ঞানও এগোচ্ছে। সে অগ্রগতি অবিশ্বাস্য। শুক্রাণু-ডিম্বাণু ছাড়াই ভ্রূণ তৈরি করে ফেললেন বিজ্ঞানীরা! হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। কোনও নারী-পুরুষ, ডিম্বাণু-শুক্রাণুর মিলন, নিষেক – কোনও কিছু ছাড়া কৃত্রিমভাবে গবেষণাগারে তৈরি হল স্তন্যপায়ী ইঁদুরের (Mouse)ভ্রূণ। ইজরায়েলের (Israel) এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এই সিন্থেটিক ভ্রূণ তৈরি করেছেন। আর এতে নতুন প্রাণ বিস্তারের ক্ষেত্রে নতুন রাস্তা দেখছে ওয়াকিবহাল মহল।
ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউটের ওই বিজ্ঞানীদের দাবি, তাদের ‘ভ্রূণ মডেল’ স্টেম সেল ব্যবহার করে তৈরি। এটি দেখতে অনেকটা ১৪ দিন বয়সী প্রকৃত ভ্রূণের মতো। এমনকি এটি হরমোন নিঃসরণ করেছে। পরে ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভাবস্থার পরীক্ষাতেও ইতিবাচকও ফলাফল দিয়েছে। মূলত মানুষের জীবনের প্রথম দিকের মুহূর্ত বোঝার জন্যই এই ভ্রূণ মডেল তৈরি করেছেন ওই বিজ্ঞানীরা। ওই পরীক্ষায় দেখা যায়, ডিম্বাণুর ভেতর শুক্রাণু নিষিক্ত হওয়ার এক সপ্তাহ পর আকারগত নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ওই কোষ সংগ্রহ করার পর দেখা যায়, সেটি অনেকটা শিশুর আকৃতির অবয়ব।
ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের গবেষক অধ্যাপক জ্যাকব হানা বলেছেন, শুক্রাণু দিয়ে ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার পরের এক সপ্তাহ ডিম্বাণুটি নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এরপর প্রায় অস্পষ্ট কোষগুলো নিজেদের আকার পরিবর্তন করে পর্যবেক্ষণযোগ্য মানবশিশুর আকৃতি পায়। মূলত এই গুরুত্বপূর্ণ সময়েই গর্ভপাত এবং বিকলাঙ্গ শিশুর গঠনের মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না।
অধ্যাপক জ্যাকব হানা বিবিসিকে বলেন, ‘এটি ব্ল্যাক বক্সের মতো। এটি প্রচলিত কোনো বিষয় নয়। এ নিয়ে আমাদের জ্ঞান খুব সীমিত।’
যেভাবে ভ্রূণ গঠন করা হয়েছে:
ভ্রূণটি তৈরি করতে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর বদলে প্রাথমিক পর্যায়ের এমন কিছু স্টেম সেল ব্যবহার করেছেন, যা মানুষের শরীরের যেকোনো টিস্যুতে পরিণত হওয়ার সক্ষমতা রাখে। পরে মডেলটিতে এমন সব রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, যা মানুষের ভ্রূণের প্রাথমিক পর্যায়ের চারটি কোষের গঠনকে নিশ্চিত করেছে।
চার ধরনের কোষগুলো হলো—১. এপিব্লাস্ট কোষ; যেগুলো থেকে পরিপূর্ণ ভ্রূণ গঠিত হয় ২. ট্রপোব্লাস্ট কোষ; যেগুলো থেকে অমরা গঠিত হয় ৩. হাইপোব্লাস্ট সেল; যেগুলো থেকে ডিম্ব থলি গঠিত হয় এবং ৪. এক্সট্রাএমব্রায়োনিক মেসোডার্ম কোষ। সব মিলিয়ে ১২০টি এমন ধরনের কোষ একসঙ্গে নির্দিষ্ট উপাদানে মিশ্রিত করা হয়েছে। এরপর বিজ্ঞানীরা মিশ্রণটিকে পর্যবেক্ষণের জন্য রেখে দেন।
প্রাথমিকভাবে মিশ্রণের মাত্র ১ শতাংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ শুরু করে। সেই কোষগুলো পরে নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হতে শুরু করে। মিশ্রণটি এমন একটি কাঠামো তৈরি করে, যা মানুষের ভ্রূণের সঙ্গে মিলে যায়, কিন্তু হুবহু মানুষের ভ্রূণের মতো নয়।
ইসরায়েলি বিজ্ঞানী দলের দাবি, এটি প্রথম কোনো পূর্ণাঙ্গ ভ্রূণ মডেল। প্রাথমিক ভ্রূণের মধ্যে যতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকে, তার সবই এর মধ্যে আছে।
অধ্যাপক হান্না বলেন, এটি সত্যিকারে পাঠ্যবইয়ে প্রকাশিত ১৪ দিনের ভ্রূণের ছবির মতো। এর আগে এ ধরনের কাজ হয়নি।
অধ্যাপক হান্না বলেন, ‘আমি এই কোষগুলোকেই বড় কৃতিত্ব দিতে চাই। আপনাকে কোষগুলোর মিশ্রণ সঠিকভাবে করতে হবে এবং সঠিক পরিবেশে কাজটি করতে হবে। তাহলেই সাফল্য পাওয়া যাবে।’
ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার ১৫ দিন পর সত্যিকারের ভ্রূণ যে অবস্থায় থাকে, সে রকম অবস্থায় না পৌঁছানো পর্যন্ত ভ্রূণ মডেলকে বাড়তে দেওয়া হয়। অনেক দেশেই স্বাভাবিক ভ্রূণসংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে এটি বৈধ।
গবেষকেরা বলছেন, ভ্রূণের এই মডেল মানুষের বিভিন্ন ধরনের কোষ কীভাবে গঠিত হয়, কীভাবে মানুষের প্রাথমিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গঠিত হয় সে বিষয়ে জানার এক নতুন দ্বার খুলে দেবে। পাশাপাশি বিভিন্ন বংশগতি রোগের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কেও জানার সুযোগ দেবে। এরই মধ্যে এই গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, যদি ভ্রূণের চারপাশ ঘিরে অমরা বা প্লাসেন্টা কোষের আস্তরণ না থাকে তবে ভ্রূণ বিকশিত হতে পারে না। বিজ্ঞানীরা আরও বলছেন এই গবেষণা ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (আইভিএফ) সাফল্যের হারও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখাতে পারে।
এই গবেষণা নিয়ে বেশ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের গবেষক অধ্যাপক রবিন লভেল বাজ। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি দারুণ একটি অর্জন। তাঁরা খুব ভালো কাজ করেছে। এটি আমাদের জন্য ইতিবাচক পথ দেখাবে এবং আমি এতে বেশ আশাবাদী।’ তবে রবিনের মতে, এই গবেষণায় আরও অনেক উন্নতির অবকাশ রয়েছে। তাঁর মতে, যে ৯৯ শতাংশ মিশ্রণ কাজ করেনি সেগুলোকেও কাজ করাতে হবে। তবে তিনি আশাবাদী যে, খুব শিগগিরই সেই সাফল্যও অর্জিত হবে।