আফিফ-মিরাজের ব্যাটে বাংলাদেশের দুর্দান্ত জয়
আফগানিস্তানের ছোট্ট সংগ্রহ ২১৫ রান তাড়া করতে নেমে ৪৫ রানে নেই বাংলাদেশের ৬ উইকেট। আফগানদের বঁহাতি পেসার ফজলহক ফারকীর তোপে পড়ে কী ভয়াবহ বিপর্যয়? ফারকী একাই তুলে নেন প্রথম ৪ উইকেট। বাংলাদেশের সামনে বড় হারের চোখ রাঙাণি! কিন্তু তিন কাঠির খেলা ক্রিকেটে শেষ বলে কিছু নেই। যে কোনো সময় বাঁক নিতে পারে ম্যাচের গতি-প্রকৃতি। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-আফগানিস্তানের তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে সে রকমই দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। বাঁক নিয়েছে ম্যাচ। হারের কিনারা থেকে ফিরে এসে আফিফ-মিরাজের সপ্তম উইকেট জুটিতে রেকর্ড গড়া অবিচ্ছিন্ন ১৭৪ রান বাংলাদেশকে জয় এনে দিয়েছে ৭ বল বাকি থাকতেই ৪ উইকেটে। আফিফ-মিরাজ দুই জনেই খেলেন ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। আফিফ ৯৩ ও মিরাজ ৮১ রানে অপরাজিত থাকেন। ম্যাচ সেরা হয়েছেন মিরাজ। তার ম্যাচ সেরা হওয়ার পেছনে বল হাতে কৃপনতা দেখানো। ১০ ওভারে ২৮ রান দেন। যদিও তিনি কোনো উইকেট পাননি। আফিফ জিতে নেন মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার অব দ্যা ম্যাচের পুরস্কার। তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল ১-০ ব্যবধানে। ১৩ খেলায় পয়েন্ট ৯০। আফগানিন্তান আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগে পেল প্রথম হার। আগের ৬ ম্যাচেই তারা জয় পেয়েছিল।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের আতঙ্ক ছিল তাদের স্পিন ত্রয়ী রশিদ-নবী-মুজিব। কিন্তু এই তিন জন নয়, বাংলাদেশ শিবিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিলেন বাঁহাতি পেসার ফজলহক ফারকী। বিপিএলে তিনি খেলেছিলেন মিনিস্টার গ্রুপ ঢাকার হয়ে। নিয়মিত খেলার সুযোগই পাননি। মাত্র ৩ ম্যাচ খেলে উইকেট পেয়েছিলেন ২টি। সেই ফজল হক ফারকী তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওভারে (হবে ১০ বলের ব্যবধানে) জোড়া আঘাত হেনে বাংলাদেশের কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। একে একে তিনি তুলে নেন লিটন দাস (১), তামিম ইকবাল (৮), মুশফিকুর রহিম (৩) ও অভিষিক্ত ইয়াসির আলীর (০) উইকেট। লিটন ও তামিমের উইকেট তিনি নিয়েছিলেন রিভিউ নিয়ে। দুইবারই আম্পায়ারকে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছিল। দলের রান তখন মাত্র উইকেটে ১৮। এই বিপর্যয় আরো ঘনিভূত হয় মুজিব সাকিবকে (১০) ও রশিদ খান মাহমুদউল্লাহকে (৮) ফিরিয়ে দিলে। সাকিব অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল টেনে এনে প্লেইড অন আর মাহমুদউল্লাহ অহেতুক জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দেন নজিবুল্লাহ জাদরানের হাতে। মুজিব চতুর্থ ওভারে এসে উইকেট পেলেও রশিদ খান দ্বিতীয় বলেই পেয়ে যান উইকেট। দলের রান ৬ উইকেটে ৪৫। হারের কালো মেঘ ভেসে উঠতে থাকে বাংলাদেশের আকাশে। সূর্যাস্তের অনেক সময় থাকলেও সাগরিকায় যেন আগে-ভাগেই সূর্যাস্ত হতে থাকে। গুমোট পরিবেশ। জয়-পরাজয় খেলারই অংশ। আফগানিস্তানের কাছেও হারতে পারে বাংলাদেশ। কিন্তু তাই বলে বড় ব্যবধানে? আবার যে ম্যাচ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার প্রশ্নে জড়িত। লম্বা (৮জন) ব্যাটিং লাইন থাকায় তখনো ছিলেন দুই ব্যাটসম্যান আফিফ ও মিরাজ। আফিফ রঙিন পোষাকের দুনিয়া যাত্রা শুরু করেছেন, কিন্তু এখনো নিজেকে নির্ভারতার প্রমাণ দিতে পারেননি। মিরাজ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলার সময় ছিলেন ব্যাটিং অলরাউন্ডার। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে যাত্রা শুরু করে বল হাতে সাফল্য পেয়ে ব্যাট হাতে আর নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি। আবার ওয়ানডে দলেও নিয়মিত নন। কিন্তু এই দুইজন কতোটুকুই আর দলকে টেনে নিতে পারবেন। কতোটুকুই বা ভরসা করা যায়। বড় জোরে তারা দলের হারের ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারবেন কিংবা লজ্জ্বার হার থেকে দলকে বাঁচাতে পারবেন?
মিরাজ যখন ক্রিজে আসেন, তখন আফিফের রান ৭। এরপর দুই জনেই এগিয়েছেন প্রায় সমান তালে। বলও যেমন ছিল প্রায় সমান সমান, তেমনি রান সংগ্রহও। আপিফ ৬৪ বলে হাফ সেঞ্চুরি করার পর মিরাজ করেন ৭৯ বলে। আফিফের প্রথম, মিরাজর দ্বিতীয়। আগের ফিফটি ছিল ৫১ রানের। জুটিতে ৫০ রান আসে ৫৮ বলে। শতরান করতে বল খেলেন ১৪১টি। এরপর তারা জুটিতে ইমরুল কায়েস ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ২০১৮ সালে মিরপুরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা ১২৭ রান অতিক্রম করে যান। ধীরে ধীরে বড় হারের শঙ্কা কাটতে থাকে। এর মাঝে ফ্লাড লাইটও চলে যায়। আবার আলো জ্বলে উঠলেও তাতে দুই ব্যাটসম্যানের মনসংযোগে কোন চিড় ধরাতে পারেনি। এরপর দুইজনে ছুটে চলেন জয়ের দিকে। দলকে জয় এন দিতে গিয়ে তারা সপ্তম উইকেট জুটিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ার পথেও এগুচ্ছিলেন। এই জুটিতে সর্বোচ্চ রান ছিল ইংল্যান্ডের জস বাটলার ও আদিল রশিদের ১৭৭ রান। তারা করেছিলেন ২০১৫ সালে বার্মিংহামে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। টার্গেট পূরণ হয়ে যাওয়াতে মাত্র ৪ রানের জন্য আফিফ-মিরাজ তারা বিশ্ব রেকর্ড গড়তে পারেনি। ১৭৪ রান করে সবার মলিন মুখে হাসি ফুটিয়ে বীরের বেশে ফিরে আসেন।
দুই জন কোনো ঝুঁকিতে যাননি। আবার সুযোগ পেলে চড়াও হয়েছেন। যেমন ইয়ামিন আহমদ জাইয়ের এক ওভারে দুই জনে মিলে আদায় করে নেন ১৫ রান। তারপর আবার চুপচাপ। সিঙ্গেলসের উপর নির্ভর করে এগুতে থাকেন। যে কারণে পরের বাউন্ডারি এসেছে ২৯ বল পর। এর পরের বাউন্ডারি ১৮ বল পর। দুইবারই আফিফের ব্যাট থেকে। মাঝে এমনও গিয়েছে ৪০ বলে কোনো বাউন্ডারি ছিল না। কিন্তু দলের রান ঠিকই এগুচ্ছিল। ফলে দলের রান রেট তারা ৪০ ওভার পর্যন্ত পাঁচের অনেক নিচেই রেখেছিলেন। ৪১ থেকে ৪৫ ওভার পর্যন্ত দলের রান রেট ছিল পাঁচের উপর। এ সময় রশিদ-নবী-মুজিব হাত ঘুরাচ্ছিলেন। ৪৫ ওভার শেষে দলের রান ছিল ৬ উইকেটে ১৮৭। জয়ের জন্য প্রয়োজন ৩০ বলে ২৯ রান। ৪৬ ও ৪৮ নম্বর ওভারে ইনিংসের শুরুতেই জগদ্দল পতরের মতো চেপে বসা সেই ফজলহক ফারকীকেই আফিফ ও মিরাজ মিলে রান নিয়ে দলের জয়কে আরো সহজ করে তুলেন। যে কারণে ৪৭ নম্বার ওভারে রশিদ খান ১ রান দিলেও আফিফ-মিরাজ খেলাকে শেষ ওভারে নিতে দেননি। রান সমান হয়ে যাওয়ার পর গুলবাদিন নাইবকে চার মেরে আফিফ দলকে দুর্দান্ত জয় এনে দেন। আফিফ ১১৫ বলে ১ ছক্কা ও ১১ চারে ৯৩ ও মিরাজ ১২০ বলে ৯ চারে ৮১ রান করে অপরাজিত থাকেন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
আফগানিস্তান: ২১৫/১০, ওভার ৪৯.১ ( নাজিবুল্লাহ জাদরান ৬৭ , রহমত শাহ ৩৪, হাসমাতউল্লাহ শহিদী ২৭, মোহাম্মদ নবী ২০, ইব্রাহীম জাদরান ১৯, গুলবাদিন নাইব ১৭, রহমানউল্লাহ গুরবাজ ৭, ইয়ামিন আহমদজাই ৫, ফজলহক ফারকী ০*,রশিদ খান ০, মুজি-উর-রহমান ০, অতিরিক্ত মোস্তাফিজ ৩/৩৯, শরিফুল ইসলাম ২/৩৮, তাসকিন ২/৫০, সাকিব ২/৫৫ মাহমুদউল্লাহ ১/৪, মেহেদি হাসান মিরাজ ০/২৬)।
বাংলাদেশ: ২১৯/৬, ওভার ৪৮.৫ ( আফিফ হোসেন ৯৩* মেহেদি হাসান মিরাজ ৮১* সাকিব ১০,তামিম ইকবাল ৮, মাহমুদউল্লাহ ৮, মুশিফিকুর রহিম ৩, লিটন দাস ১ , ইয়াসির আলী ০, ফজলহক ফারুকী ৪/৫৪, মুজিব ১/৩২, রশিদ খান ১/৩০, মোহাম্মদ নবী ০/৩০, গুলবাদিন নাইব ০/২৫, ইয়ামিন আহমদজাই ০/৩৫)।
এমপি/এএস