‘দুইটা চা একটা পাইলট’
সময় ও স্রোত কারও জন্য বসে থাকে না। চলে তার আপন গতিতে। বহমান এই ধারায় মানুষকে টানে অতীত। বারবার ফিরে যেতে মন চায় ফেলে আসা দিনগুলোতে। যদিও কবি বলেছেন, ‘অতীত চলে গেছে, তাই এটা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেও লাভ নেই। কারণ তা এখনো আসেনি। চিন্তা করো বর্তমান সময় নিয়ে। সেটাই তোমার ভবিষ্যতের জন্য ভালো।’
কিন্তু চাইলেই কি অতীত ভোলা যায়? উপেক্ষা করা যায়? যায় না বলেই তো হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে।’
অতীতকে হয়তো ভবিষতে নিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু বর্তমানে ফিরিয়ে আনা যায়। এভাবেই ফেলে আসা অতীতকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনেছিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সফল, জনপ্রিয় ও পরিচিত মুখ কুতুবউদ্দিন আহমেদ। ক্রীড়াঙ্গন ছেড়েছেন ২০১২ সালে। সেসময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) মহাসচিব। এ ছাড়াও জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন সভাপতি ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসেবে।
ব্যক্তি জীবনে তিনি সফল ব্যবসায়ী। দেশের সুপিরিচিত ও স্বনামধন্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করার পাশাপাশি তিনি ব্যবসায়ী সংগঠন বিজেএমইএ (বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন) ও এমসিসিআইয়ের (মেট্টোপলিটন চেম্বার অ্যান্ড কর্মাস ইন্ডাস্ট্রি) মতো সংগঠনেরও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সফলতার সঙ্গে। কিন্তু সংগঠক হিসেবে শুরু ক্রীড়াঙ্গন থেকেই। পরিচিতি লাভও করেন ক্রীড়াঙ্গন থেকেই। তাইতো ২০১২ সালে ক্রীড়াঙ্গন ছাড়লেও ভুলতে পারেননি ক্রীড়াঙ্গনকে। তার অন্তরে বসবাস ক্রীড়াঙ্গনের। হৃদয়ে লালন করে বহে নিয়ে চলেছেন আজও অবদি। যে কারণে পুরোনো মুখদের দেখতে, তাদের অনেককে নিয়ে ‘নস্টালজিক’ হতে বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে আয়োজন করেছিলেন ‘গেট টুগেদার’।
রাজধানীর বনানীতে তার নিজস্ব মালিকাধীন হোটেল প্লাটিনাম গ্র্যান্ডে সেই ‘গেট টুগেদার’ হয়ে উঠেছিল ক্রীড়াঙ্গনের ছোটো-খাটো এক মিলনমেলা। বিওএর বর্তমান মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা থেকে শুরু করে বর্তমান ও সাবেক ক্রীড়া সংগঠক, সাবেক তারকা ক্রীড়াবিদ ও সিনিয়র সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে গেট টুগেদার হয়ে উঠেছিল শুধুই অতীতের স্মৃতিচারণ।
এমন আবেগমাখা আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন সাবেক ক্রীড়া সচিব মাহবুবুর রহমান, বিওএর সাবেক সহসভাপতি মিজানুর রহমান মানু, ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান মিকু, হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামন কোহিনুর, বাস্কেটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এ কে সরকার, সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এ বি সাইফ, খো খো ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান বাবুল, বিওএর সাবেক উপ মহাসচিব ইমতিয়াজ খান বাবুল, তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান রানা, আর্চারি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি আনিসুর রহমান দিপু, উশু ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দিলদার হোসেন দিলু, ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন জোবায়েদুর রহমান রানা, সাবেক দুই জাতীয় মহিলা ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন কামরুন্নাহার ডানা ও মরিয়ম তারেক, মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সভাপতি রাফিয়া আক্তার ডলি, ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সাবেক ট্রেজারার শফিউর রহমান মন্টু, গিনেস বুকে নাম লেখানো সাবেক টেবিল টেনিস খেলোয়াড় জোবেরা রহমান লিনু, জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার আব্দুল গাফ্ফার, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের পরিচালক আবু হাসান চৌধুরী প্রিন্স প্রমুখ।
দুই দশকেরও বেশি সময় যে ক্রীড়াঙ্গনে দিয়েছেন জীবনের ব্যস্তময় মুহূর্ত, সেখানকার প্রিয়জনদের পেয়ে কুতুবউদ্দিন আহমেদ স্মৃতিকাতর হয়ে উঠেন। রাজউকের বিপরীতে সুরম্য অলিম্পিক ভবন নির্মাণ হয়েছিল অনেকটা শূন্য তহবিল থেকে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে। কীভাবে সেই তহবিল সংগ্রহ হয়েছিল, হাসতে হাসতে করছিলেন সেই স্মৃতিচারণ।
স্মৃতির সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে তিনি চলে যান আরও অতীতে। ষাট দশকে স্কুলজীবনে। বিওএর বর্তমান মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজাকে নিয়ে করছিলেন সেই স্মৃতিচারণ। নিউমার্কেটের ভেতরে একটি দোকানে তারা সময় কাটাতেন। আড্ডা মারতেন। টাকা বাঁচাতে চা ভাগাভাগি করে খেতেন। সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে কুতুবউদ্দিন বলেন, ‘আমরা তিনজন থাকলে অন্য কিছু পুরো খেলেও চা নিতাম কম। দুই কাপ চা নিয়ে তিনজন খেতাম। তখন বলতাম দুই কাপ চা, একটা পাইলট।’ খালি কাপকে তারা পাইলট বলতেন।
এক দশকের বেশি সময় পর সবাইকে পেয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন কুতুবউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ওই যে বলে না আই ফিল নস্টালজিক। ওইটাই। জাস্ট সবাইকে দেখার জন্যই এই আয়োজন। অন্য কোনো কারণ নেই। খেলা ছাড়ার পর অনেকের সঙ্গেই এই প্রথম দেখা হলো। কোভিডের কারণে আরও যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। এতদিন পর সবাইকে দেখে খুবই ভালো লাগছে। স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়ছে। ক্রীড়াঙ্গনে যতদিন ছিলাম সবার সহযোগিতা পেয়েছি। সবাই সহযোগিতা না করলেতো আর আমি সাকসেস হতে পারতাম না।’
কুতুবউদ্দিন যখন স্মৃতিচারণ করছিলেন, তখন পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সৈয়দ শাহেদ রেজা। তার সেই স্মৃতিচারণে নিজে শামিল হয়ে বলেন, ‘কুতুব ভাইতো আমার ভাই। আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিরাট একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করেছেন। এটাতো সব সময় হয় না। এই সুযোগে সবার সঙ্গে একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে যায়। অনেকের সঙ্গে আমার অনেক দিন পরও দেখা হলো।’
কুতুবউদ্দিনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় জানিয়ে সৈয়দ শাহেদ রেজা বলেন, ‘তার সঙ্গে আমার প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার যোগাযোগ হয়, দেখা হয়। আমি যখন প্রথম অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে মনোনয়নপত্র জমা দেই, সেটি কুতুব ভাই নিজে জমা দিয়েছিলেন। আমি নির্বাচন করার আগে তাকে বলেছিলাম, আপনি যদি আগ্রহী হন, তাহলে আমি নির্বাচন করব না। আপনার কমিটিতে আমি একজন সদস্য হিসেবে থাকব। আমাদের সর্ম্পক এরকমই।’
এমপি/এসজি