তীর হারা ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ
“তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর
পাড়ি দিব রে
আমরা ক’জন নবীন মাঝি
হাল ধরেছি শক্ত
করে রে”
মুক্তিযুদ্ধে রক্ত গরম করা গান। এ গানের সঙ্গে কেমন জানি একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় নিউ জিল্যান্ড সফরে প্রথম টেস্টে ৮ উইকেটে জয় পাওয়া বাংলাদেশ দলের সঙ্গে।
তিন ফরম্যাটে ৩২ ম্যাচ খেলেও নিউ জিল্যান্ডে ছিল না বাংলাদেশের কোনো জয়। শুধু বাংলাদেশই নয় ২০১১ সালের পর উপমহাদেশের কোনো দল জিততে পারেনি। ২০১৭ সালের পর নিউ জিল্যান্ড নিজ মাটিতে হারেনি কোনো টেস্ট। তাই নিউ জিল্যান্ডে টেস্ট খেলা মানেই উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার নামান্তর। কিন্তু এবার আর বাংলাদেশ ডুবে যায়নি। বিজয় নিশান উড়িয়ে দিয়েছে নিউ জিল্যান্ডের উত্তাল সাগরে। কাণ্ডারি মুমিনুলের ঢাল-তলোয়ার ছিলেন এক ঝাঁক তরুণ। সেই তরুণদের কাঁধে সওয়ার হয়ে মুমিনুল এ উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়েছেন। ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্স হলো মাহমুদুল হাসান জয় (৭৮ রান), নাজমুল হোসেন শান্ত (৬৪+১৭ রান), মুমিনুল হক সৌরভ (৮৮+ ১৩* রান, বল হাতে ২ উইকেট), লিটন দাস (৮৬ রান, সঙ্গে ৪ ক্যাচ)।
বলারদের পারফরম্যান্স হলো এবাদত হোসেন (১+৬ উইকেট),শরিফুল ইসলাম (৩ উইকেট), তাসকিন আহমেদ (৩ উইকেট), মেহেদী হাসান মিরাজ (৪৭ রান সঙ্গে ৩+১ উইকেট)। ব্যাটে-বলে যুদ্ধের ময়দানে এরাই ছিলেন অগ্রণি। সাদমান ইসলাম ৫ (৪+১ সঙ্গে ব্যাট হাতে ২২ +৩ রান) ক্যাচ ধরে ছিলেন। ইয়াসির আলী প্রথম ইনিংসে মেহেদী হাসান মিরাজের সঙ্গে জুটি বেঁধে ৭৫ রান যোগ করে দলের লিড নিতে ভূমিকা রাখেন। যেখানে তার অবদান ছিল ২৬ রানের। বাউন্ডারি মেরে জয় সূচক রান এসেছে মুশফিকুর রহিমের ব্যাট থেকে। এবার বড় চোখে তাকালে দেখা যায় জয়ের পেছনে রয়েছে তরুণদের অবদানই বেশি।
২০১৯ সালে অভিষেক হয় এবাদত হোসেনের। টেস্ট খেলেছেন এর আগে ১০টি। উইকেট ১১টি। সেরা একাদশে তার অর্ন্তভুক্তি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। অবশেষে তিনিই হয়ে উঠলেন ম্যাচের নায়ক। দ্বিতীয় ইনিংসে একাই নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন গুঁড়িয়ে দেন। ২০১৭ সালে তাসকিন আহমেদের টেস্ট অভিষেক। ৮ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে খেলতে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে এবাদতকে দিয়েছেন যোগ্য সাহচর্য্য। নিয়েছেন ৩ উইকেট। প্রথম ইনিংসে কোনো উইকেট না পেলেও তিনি হয়েছিলেন ত্রাস।
মাহমুদুল হাসান জয় এক টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে খেলতে নেমে ২২৮ বলে ৭৮ রানের ইনিংস খেলে সর্বত্র বাহবা কুড়িয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটে তিনি টিকে থাকতে এসেছেন। ফিল্ডিং করতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ে আঙুলে তিনটি সেলাই পড়েছে। এ ইনজুরি তাকে ছিটকে দিয়েছে সিরিজ থেকে। নাজমুল হোসেন শান্ত ২০১৭ সালে সাদা পোশাকে অভিষেকের পর ১১ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে খেলতে নেমে ৬৪ রানের ইনিংস খেলন। প্রথম ইনিংসে তিনি মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ১০৪ রান যোগ করে বাংলাদেশের ভিত মজবুত করার ক্ষেত্রে অগ্রণি ভূমিকা পালন করেন। সাদমান ইসলামের এটি ছিল ১১তম টেস্ট। মাহমুদুল হাসান জয়ের মতোই ইয়াসির আলী ও শরিফুল খেলেছেন দ্বিতীয় টেস্টে।
১১ জনের দলের ৭ জনই তারুণ্যের ঝাণ্ডা হাতে। ২৫ বছর বয়সী অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সাবেক দলপতি মেহেদী হাসান মিরাজ ২০১৬ সালে আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে পথ চলা শুরু করেন। পরে খেলেছেন ২৮ টেস্ট। ২৭ বছর বয়সী লিটন দাসের ছিল ৩০তম টেস্ট।
অভিজ্ঞতা বলতে যা বোঝায় তা ছিল একমাত্র মুশফিকুর রহিমের। ২০০৫ সালে লর্ডসে অভিষেকের পর তিনি নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন ৭৮তম টেস্ট। কিন্তু জয়সূচক রান ছাড়া তার কাছ থেকে সেভাবে কোনো সাপোর্ট পাওয়া যায়নি। এক ইনিংস ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে তিনি করেছিলেন ১২ রান।
মুশফিকের অবদান সর্ম্পকে মুমিনুল বলেন, ‘মুশফিক ভাই ছিলেন সবচেয়ে অভিজ্ঞ। ব্যক্তিগতভাবে উনি আমার সঙ্গে অনেক কথা বলেছেন। তরুণ অধিনায়ক হিসেবে উনি আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন।’
৩০ বছর বয়সী দলপতি মুমিনুল দলের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ক্রিকেটার ৪৮তম ম্যাচ খেলতে নেমে ব্যাটে-বলে নিজেও যেমন অবদান রেখেছেন তেমনি যোগ্য কাণ্ডারি হয়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে নিউ জিল্যান্ডের ২২ গজের পিচ নামের উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে তরী নিয়ে ভিড়িয়েছেন তীরে।
মুমিনুল বলেন, ‘আমরা যখন সম্মিলিতভাবে সবাই ভালো খেলি, তখন ফল আমাতের পক্ষে আসে। এটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সবাই সবদিক থেকে কিছু না কিছু অবদান রেখেছে। যে ব্যাটিংয়ে পারেনি সে বোলিং, যে বোলিংয়ে পারেনি সে ফিল্ডিংয়ে করেছে।’
এমপি/এসএন/এসএ/